Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

বিদ্যুৎ বাড়তি, বহু পিপিএ বাতিল করল রাজ্য

বাম আমলে একাধিক বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি (পাওয়ার পার্চেজ এগ্রিমেন্ট বা পিপিএ) বাতিল করল রাজ্য সরকার। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা সূত্রে বলা হচ্ছে, বিদ্যুতের চাহিদা ভবিষ্যতে কতটা বাড়তে পারে, সেই হিসেবেই কিছুটা গলদ রয়ে গিয়েছে। আগামী দশ বছরে যতটা বিদ্যুৎ লাগতে পারে ধরে নিয়ে পিপিএ সই করা হয়েছে, ততটা বিদ্যুৎ মোটেই লাগবে না। সেই কারণেই চুক্তি বাতিল করা হচ্ছে।

পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০১৪ ০৩:৫০
Share: Save:

বাম আমলে একাধিক বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি (পাওয়ার পার্চেজ এগ্রিমেন্ট বা পিপিএ) বাতিল করল রাজ্য সরকার। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা সূত্রে বলা হচ্ছে, বিদ্যুতের চাহিদা ভবিষ্যতে কতটা বাড়তে পারে, সেই হিসেবেই কিছুটা গলদ রয়ে গিয়েছে। আগামী দশ বছরে যতটা বিদ্যুৎ লাগতে পারে ধরে নিয়ে পিপিএ সই করা হয়েছে, ততটা বিদ্যুৎ মোটেই লাগবে না। সেই কারণেই চুক্তি বাতিল করা হচ্ছে। কেননা, চুক্তি বাতিল না-করলে ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি যে দিন চালু হবে সে দিন থেকে রাজ্য বিদ্যুৎ কিনতে বাধ্য থাকবে। আর বিদ্যুৎ না-কিনলে ক্ষতিপূরণ বাবদ ভর্তুকি দিতে হবে সংশ্লিষ্ট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে। যে আর্থিক বোঝা শেষমেশ গিয়ে চাপবে সাধারণ গ্রাহকদের ঘাড়ে।

রাজ্যের বিদ্যুৎসচিব গোপালকৃষ্ণ বলেন, “বেশ কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। ভবিষ্যতের চাহিদা এবং জোগানের মধ্যে অসঙ্গতি রয়েছে বলেই এই সিদ্ধান্ত। কারণ প্রয়োজনের বাইরে বিদ্যুৎ কিনলে বণ্টন সংস্থার ঘাড়ে আর্থিক ক্ষতির বোঝা চাপবে।”

চুক্তি বাতিল নিয়ে রাজ্যের বিদ্যুৎ কর্তাদের একাংশের আরও যুক্তি, বেশির ভাগ নতুন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রেই দামি বিদেশি কয়লা ব্যবহার করা হবে। তাঁদের দেওয়া হিসেব বলছে, ২০১০-১১ আর্থিক বছরে যেখানে ৬ কোটি ৮০ লক্ষ টনের মতো কয়লা আমদানি করতে হয়েছিল সেখানে ২০১৪ সালে কমপক্ষে ১৮ কোটি টনের মতো কয়লা আমদানি করতে হবে। চাহিদা বাড়ছে দেখে গত পাঁচ বছরে আমদানিকৃত কয়লার দাম ১৫০-২০০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে বলে শিল্পমহলের দাবি। এই পরিস্থিতিতে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলির বিদ্যুতের দামও বেশি হবে। কিন্তু মাসুল বৃদ্ধির ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোর আপত্তি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্মতি পাওয়ার পরেই বেশ কিছু সংস্থাকে চুক্তি বাতিলের চিঠি পাঠানো হয়েছে। রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার চেয়ারম্যান স্বরূপনারায়ণ নিগম বলেন, “মূলত বিদ্যুতের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যই আমরা কিছু চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

সিইএসসি এলাকা বাদ দিয়ে রাজ্যের এখন বিদ্যুৎ চাহিদা গড়ে ৫০০০ থেকে ৫২০০ মেগাওয়াটের কাছাকাছি। যার মধ্যে গড়ে ৩০০০ মেগাওয়াট রাজ্যের সরকারি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি থেকেই পাওয়া যায়। বাকি বিদ্যুৎ আসে বিভিন্ন জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং এনটিপিসি, এনইচপিসির মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির কাছ থেকে।

বিদ্যুৎ কর্তাদের দাবি, রাজ্যে বিদ্যুতের চাহিদা গড়ে প্রতি বছর ৪-৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। সেই হিসাবে আগামী দশ বছরে (২০২৪-২৫) রাজ্যের বিদ্যুতের চাহিদা যেখানে গিয়ে দাঁড়াতে পারে, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চুক্তিগুলি করা হয়নি। রাজ্যের নিজের উৎপাদন ক্ষমতাও যে আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে বেড়ে যাবে, সেটা হিসেবের মধ্যে রাখা হয়নি।

২০১৪-১৫ সালে ডিপিএলের ২৫০ মেগাওয়াট ছাড়াও মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘিতে ৫০০ মেগাওয়াটের দু’টি ইউনিট চালু হবে। ২০২০ সালে পুরুলিয়ায় টুরগা পাম্প স্টোরেজের (জলবিদ্যুৎ) ৯০০ মেগাওয়াটের প্রকল্প ও কাটোয়ায় এনটিপিসি-র তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হয়ে যাওয়ার কথা। এ ছাড়াও বিদ্যুতের অন্যান্য উৎস তো রয়েছেই। সে ক্ষেত্রে নতুন চুক্তি অনুসারে বিদ্যুৎ কিনলে তা ব্যবহার করা হবে কোথায়!

এই যুক্তি অবশ্য মানতে নারাজ আগের বাম সরকারের কর্তাব্যক্তিরা। সিপিএম নেতৃত্বের বক্তব্য, প্রতি বছর যে পরিমাণ বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে বলে ইঞ্জিনিয়াররা হিসেব করেছিলেন, এক সময় দেখা যায় কার্যক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি চাহিদা বাড়ছে। ভবিষ্যতে যাতে বড় সঙ্কটের মুখে পড়তে না হয়, সে দিকে লক্ষ রেখেই বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করা হয়েছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। শিল্প পরিস্থিতি বেহাল বলেই বিদ্যুতের চাহিদা কমছে। এবং বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি বাতিল করতে হচ্ছে।

সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্যামল চক্রবর্তীর কথায়, “গত বছর সংসদে কেন্দ্রের দেওয়া তথ্য অনুসারে পশ্চিমবঙ্গে ৪৯ হাজার ছোট কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ডানলপ, জেসপ, হিন্দমোটরের মতো বড় কারখানাও বন্ধ হচ্ছে। ফলে বিদ্যুতের চাহিদা কমছে। আর সেই কারণেই রাজ্য সরকার বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি বাতিল করছে, এমনটা মনে করা অমূলক নয়।”

৩৪ বছরের শাসনকালের শেষ পর্বে এসে শিল্পায়নে নজর দিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। রাজ্যের বিবর্ণ শিল্প মানচিত্রে উঁকি দিয়েছিল লগ্নির আলো। শিল্পায়ন হলে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে, এই আশায় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি (পাওয়ার পার্চেজ এগ্রিমেন্ট বা পিপিএ) করেছিল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা।

কিন্তু সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনার পর থেকে রাজ্যে বড়-মাঝারি শিল্প আসা প্রায় বন্ধ। তৃণমূল সরকারের তিন বছর পার হলেও পরিস্থিতি পাল্টায়নি। পাশাপাশি, বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ার তোড়জোড় শুরু করেও নানা সমস্যায় পড়েছে অনেক সংস্থা। এই অবস্থায় তাদের সঙ্গে একের পর এক চুক্তি বাতিল করছে বণ্টন সংস্থা।

অনাবাসী বাঙালি শিল্পপতি প্রসূন মুখোপাধ্যায়ের সংস্থা, হলদিয়ায় শিল্পপতি হেমন্ত কানোরিয়ার প্রকল্প ও শালবনিতে জিন্দলদের বিদ্যুৎ প্রকল্পের সঙ্গে পিপিএ বাতিল করবে বলে চিঠি দিয়েছে বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা। সংস্থার এক কর্তার দাবি, ইতিমধ্যেই যাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হয়েছে, তারা লিখিত ভাবে সরকারের সিদ্ধান্তে সম্মতিও জানিয়েছে। তারা নিজেরাই স্বীকার করে নিয়েছে প্রকল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন সমস্যার ফাঁদে পড়ে রয়েছে। কোনও কোনও সংস্থার সঙ্গে চুক্তি একেবারে বাতিল করা হয়নি, তবে তাদের চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, রাজ্য না-চাইলে কোনও বিদ্যুৎ তারা যেন সরবরাহ না করে। যদি প্রয়োজন হয় তবেই তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনা হবে।

এই অবস্থায় অনেক সংস্থাই মনে করছে, পিপিএ বাতিল হয়ে গেলে তারা ব্যাঙ্কঋণ ও কয়লা জোগাড় করতে পারবে না। ফলে প্রকল্পগুলি বিশ বাঁও জলে পড়ে যাবে। যদিও চুক্তি বাতিলের অর্থ প্রকল্পগুলিরই ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাওয়া, এমনটা মানতে নারাজ বণ্টন সংস্থার কর্তাদের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, সংস্থাগুলি অন্য খদ্দের দেখে নেবে।

কিন্তু এ রাজ্যে বিদ্যুতের চাহিদা আশু বাড়ার কোনও সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করছে শিল্পমহল। তাদের একটা বড় অংশের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গে ইস্পাত, পেট্রো-রসায়ন, সিমেন্টের মতো বড় শিল্প বলতে গেলে আসছেই না। আগামী কয়েক বছরে খুব বড় মাপের শিল্প আসার সম্ভাবনাও কম। ফলে গৃহস্থের চাহিদার বাইরে অন্য ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বিশেষ দরকারই হচ্ছে না। যার জেরে এখনই রাজ্যে বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত। বাংলাদেশকে প্রতিদিন ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রফতানি করছে বণ্টন সংস্থা। সংস্থা সূত্রে খবর, ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দিনের সর্বাধিক চাহিদার সময়েও রাজ্যে গড়ে ১১০০-১৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত থাকবে। পাশাপাশি রাজ্যের নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতাও আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে আরও বাড়বে। তাই ভবিষ্যতে অন্য সংস্থার কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি বাতিল করা ছাড়া রাজ্যের কোনও উপায় নেই বলেই শিল্প মহলের বক্তব্য।

কিন্তু রাজ্য কি একচেটিয়া ভাবে পিপিএ বাতিল করে দিতে পারে?

এক বিদ্যুৎ কর্তার বক্তব্য, চুক্তির শর্ত কোনও সংস্থা না মানতে পারলে সে ক্ষেত্রে যে বিদ্যুৎ কিনবে তার সিদ্ধান্তের অগ্রাধিকার থাকাটাই স্বাভাবিক। রাজ্যের দাবি, নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলি অনেকেই এখনও পর্যন্ত প্রকল্পের প্রাথমিক কাজগুলিই করে উঠতে পারেনি। কেউ ব্যাঙ্কঋণ জোগাড় করতে পারেনি। কয়লার জোগানও নিশ্চিত করা যায়নি। প্রকল্পগুলির কবে শেষ হবে, তা-ও সংস্থাগুলি স্পষ্ট করে বলতে পারছে না। ফলে রাজ্য শর্ত মতো চুক্তি বাতিল করে দিতেই পারে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE