পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়। নিজস্ব চিত্র।
কেউ রাত জেগে কেউ বা গোটা দিন ধরে ইন্টারনেটে অপেক্ষা করে বিভিন্ন দিল্লি, মুম্বই, কর্ণাটকের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে ভর্তির আবেদন করেছিলেন।
কিন্তু আবেদনই সার।
এ বছর কলেজ শেষ করা উত্তরবঙ্গের পড়ুয়াদের কাছে সে স্বপ্ন অধরাই থেকে যাচ্ছে। দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছেয় বাধ সেধেছে বিধানসভা ভোট প্রক্রিয়া। ভোটের কারণে অনেক কলেজ ভবন ব্যবহার হওয়ায় স্নাতক স্তরের ফাইনাল পরীক্ষায় মাস দু’য়েক পিছিয়ে দিয়েছে উত্তরের দুই বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষাবিদদের অবশ্য দাবি, পড়ুয়াদের স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দৃঢ় অবস্থান নিলেই এই বিপত্তি এড়ানো সম্ভব ছিল।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, জহওরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি সহ দেশের নামী দামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্নাতকোত্তর পাঠ্যক্রমে ভর্তির প্রক্রিয়া এখন প্রায় শেষের মুখে। যদিও উত্তরবঙ্গ এবং পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও কলেজের ফাইনাল পরীক্ষা শুরুই হয়নি। কলেজ ফাইনাল অথবা স্নাতকস্তরের চূড়ান্ত পরীক্ষার মার্কশিট ছাড়া স্নাতকোত্তরে ভর্তি সম্ভব নয়। ভোটের জন্য কয়েকটি কলেজ ভবন নির্বাচন কমিশন তথা সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন নিজেদের হেফাজতে নেওয়ায়, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় এবং কোচবিহারের পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা প্রক্রিয়া প্রায় তিন মাস পিছিয়ে গিয়েছে। আগামী ১৯ মে ভোট গণনার পরে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষা শুরু হবে। মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে পরীক্ষা শুরু হয়ে শেষ হতে জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পার হয়ে যাবে। অন্য দিকে, দেশের প্রথম সারির প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের পর থেকেই স্নাতকোত্তরের ক্লাস শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। শুধু ভিন রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয় কেন, রাজ্যের কলকাতা অথবা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ভর্তির প্রক্রিয়া আগামী মাসেই শেষ হয়ে যাবে। সে কারণেই আগামী জুলাই মাসের শেষে স্নাতক স্তরের মার্কশিট হাতে পেয়ে উত্তরবঙ্গের দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের পক্ষে ভিন্ন রাজ্য কেন নিজের রাজ্যের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ থাকছে না।
সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখা পড়ুয়াদের এক বছর নষ্ট হওয়ার জন্য উত্তরের শিক্ষাবিদরা প্রশাসন এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উভয়কেই দুষছেন। শিক্ষাবিদদের দাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় থাকা সব কলেজ ভবনগুলিকে নির্বাচন কমিশন ব্যবহার করছে না। যেমন গত ২ এপ্রিল থেকে শিলিগুড়ি কলেজ ভবনের দায়িত্ব নিয়েছে প্রশাসন। শিলিগুড়ি মহকুমার তিন বিধানসভা কেন্দ্রের ইভিএম বিলি এবং সংগ্রহ (ডিসিআরসি) কেন্দ্র ছিল শিলিগুড়ি কলেজ। কলেজেই তৈরি হয়েছে স্ট্রংরুম। যে কারণে কলেজের ত্রিসীমানায় কাউকে ঘেঁষতে দিচ্ছে না আধাসামরিক বাহিনী। গত ২ এপ্রিল থেকে শুরু করে আগামী ২০ মে পর্যন্ত কলেজ বন্ধ থাকবে। তবে শিলিগুড়ি শহরের অন্য কলেজগুলি ভোটের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে না। তেমনিই জলপাইগুড়ি জেলার মালবাজার, আলিপুরদুয়ার সহ বেশ কয়েকটি কলেজ ভোটের কাজের জন্য প্রশাসন নিয়েছে। তবে আনন্দচন্দ্র কলেজ, প্রসন্নদেব মহিলা কলেজের মতো অনেক কলেজেই স্বাভাবিক কাজকর্ম চলছে। শিক্ষাবিদদের একাংশ মনে করছেন, পড়ুয়াদের স্বার্থে যে কলেজগুলিতে ভোটের কাজ চলছে না, সেগুলি ব্যবহার করেই নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষা শেষ করা সম্ভব ছিল। অনেকের অভিযোগ, ভোটের কাজে কলেজ ব্যবহার করতে দেওয়া যাবে না এমন দৃঢ় অবস্থানও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নিতে দেখা যায়নি। অন্য দিকে, ভোটের কাজের জন্য কলেজ ভবনের পরিবর্তে প্রশাসন অন্য কোনও ভবন চিহ্নিত করতে পারত। যেমন চাপের মুখেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা পেছানোর সিদ্ধান্ত নেয়নি বলে শিক্ষাবিদদের দাবি।
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন প্রধান আনন্দগোপাল ঘোষ বলেন, ‘‘ঘটনা হল, ক্রমশ শিক্ষা অগ্রাধিকার এবং গুরুত্ব হারাচ্ছে। তাই স্কুল থেকে কলেজ সবই এখন ছুটি না হয অচল। একটা দু’টো কলেজে না হয় পরীক্ষা সম্ভব নয় বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাই পিছিয়ে যাবে এটা বাঞ্ছনীয় নয়। অতীতে তো এক কলেজের পড়ুয়াদের অন্য কলেজে গিয়ে পরীক্ষা দিতে হতো, এ বারও তেমন ব্যবস্থা করা যেত। পড়ুয়াদের কথা কেউ ভাবল না।’’
কী বলছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অথবা প্রশাসন?
পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দেবকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ভোট প্রক্রিয়ার জন্য পরীক্ষা পিছিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছি। নিরূপায় হয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।’’ উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার স্বপন রক্ষিত বলেন, ‘‘পড়ুয়াদের সমস্যার কথা জানি। এক কলেজের পরীক্ষার্থীদের অন্য কলেজে পরীক্ষা দেওয়ার পরিকাঠামো তৈরি করা স্বল্প সময়ে সম্ভব হয়নি। তৃতীয় বর্ষের ফল দ্রুত প্রকাশ করার চেষ্টা হবে।’’ দার্জিলিঙের জেলাশাসক অনুরাগ শ্রীবাস্তব বিষয়টি নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘কলেজভবন চেয়ে চিঠি পাঠানো হলে, বিশ্ববিদ্যালয় কোনও আপত্তি জানয়নি।’’ শিলিগুড়ি কলেজের শিক্ষিকা বিদ্যাবতী অগ্রবাল পাল্টা দাবি করে বলেন, ‘‘প্রশাসন একটি স্থায়ী স্ট্রংরুম তৈরি করতে পারে। তবেই তো ফি বছর ভোটে এই সমস্যা তৈরি হয় না।’’
রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ছাত্র আশিস পাল বলেন, ‘‘যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু যাদবপুরের স্নাতকোত্তরের প্রবেশিকা পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল, আর আমাদের কলেজের ফাইনাল পরীক্ষা শুরুই হল না। এ বছরের মতো অন্তত যাদবপুরের স্বপ্ন ভুলতে হচ্ছে।’’ শিলিগুড়ি কলেজের ছাত্র বুবাই বণিকের প্রশ্ন, ‘‘উচ্চশিক্ষায় এক বছরের দেরি মানে সেই ভার গোটা জীবনভর বয়ে নিয়ে যেতে হবে। এর জন্য কাকে দায়ী করব?’’
কলেজ শেষ করে উচ্চ শিক্ষার দোরগোড়ায় পা রাখতে চলা উত্তরবঙ্গের পড়ুয়াদের এই প্রশ্নের জবাবে প্রশাসন এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরস্পরকে দোষারোপ করছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy