এক বছর চার মাস আগে তাঁদের মেয়ের দেহ পাওয়া গিয়েছিল রেল লাইনের ধারে। ধর্ষণ করে খুনের মামলা দায়ের করতে গিয়েছিলেন তাঁরা। অথচ মামলা হয়েছিল স্রেফ আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে। তার পরে খুন হন মামলার মূল সাক্ষী। এবং সেই খুনের অভিযোগে দেড় মাস হাজতবাস করতে হয়েছিল ওই নাবালিকার বাবা-মামাকেই। আর যে সব স্থানীয় তৃণমূল নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে তাঁদের অভিযোগ ছিল, তাঁরা এখন জামিনে ছাড়া পেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এলাকা। এই পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার কামদুনি মামলার রায়ে কিছুটা হলেও আশার আলো দেখছেন ধূপগুড়ির নির্যাতিতার বাবা-মা।
তাঁদের এখন একটাই দাবি, ‘‘পুলিশ সঠিক তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করে মেয়েকে ধর্ষণ ও খুনে অভিযুক্তদের ফের জেলে পুরুক। কামদুনির মতো দ্রুত বিচার শুরু হোক।’’
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ধূপগুড়িতে এক সালিশি সভা থেকে ঘটনার সূত্রপাত। সামান্য কয়েক শো টাকা নিয়ে ঝামেলা এবং সেটা মেটাতেই ডাকা হয়েছিল সালিশি। অভিযোগ, সেখানে তার বাবাকে থুতু চাটতে ও নাকখত দিয়ে জোর করে স্থানীয় তৃণমূল কর্মীরা। তা দেখে প্রতিবাদ জানায় ওই নাবালিকা একরত্তি মেয়ে। সে তখন দশম শ্রেণির ছাত্রী। তৃণমূল কর্মীদের কেউ কেউ তাকে চুলের মুঠি ধরে টেনে আনতে চাইলে হাত ছাড়িয়ে পালায় সে। তার পর থেকেই মেয়েটি নিখোঁজ ছিল। পর দিন বাড়ি থেকে সামান্য দূরে রেল লাইনের ধারে তার ক্ষত-বিক্ষত বিবস্ত্র দেহ মেলে। সেই দিনই মেয়েটির বাবা ধূপগুড়ি থানায় মেয়েকে ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগ করেন ১৩ জন তৃণমূল কর্মীর বিরুদ্ধে। সেই তালিকায় ছিল ধূপগুড়ির ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলার নমিতা রায়ের স্বামী চন্দ্র রায়, ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি গোবিন্দ ভৌমিক-সহ মোট ১৩ জনের নাম।
ধূপগুড়ি থানা কিন্তু মামলাটি নিজেদের এক্তিয়ারে রাখেনি। মেয়েটির দেহ রেল লাইনের পাশে মিলেছিল— এই যুক্তিতে তারা মামলাটি ময়নাগুড়ি জিআরপি-তে পাঠিয়ে দেয়। অভিযোগ, তদন্ত শুরু করার ব্যাপারেও গড়িমসি ছিল যথেষ্ট। এর মধ্যে কামদুনি নিয়ে রাজ্য জুড়ে প্রবল হইচই শুরু হয়। তখন চাপের মুখে অভিযুক্তদের কয়েক জনকে ধরা হয় বলে মেয়েটির পরিবারের দাবি। বাকিরা আদালতে আত্মসমর্পণ করে।
এলাকার বাসিন্দাদের অনেকের অভিযোগ, শাসকদলের সঙ্গে যুক্ত বলেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে লঘু ধারা দিয়েছে পুলিশ, ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারার (খুন) বদলে ৩০৫ ধারায় (নাবালিকাকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়া) তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী, ৩০২ ধারায় দোষী সাব্যস্ত হলে সাজা হয় যাবজ্জীবন নয়তো ফাঁসি। আর ৩০৫ ধারায় দোষী সাব্যস্ত হলে নূন্যতম সাজা ১০ বছরের জেল। গত অগস্টে জামিনে মুক্তি পেয়ে যান অভিযুক্তেরা।
এর এক মাস পরেই মামলার প্রধান সাক্ষী নিতাই সিংহরায় খুন হয়ে যান। ওই খুনে অভিযুক্ত হিসেবে পুলিশ গ্রেফতার করে মেয়েটির বাবা ও মামাকে। মাস দেড়েক জেলে থাকার পর জামিন পান ছাত্রীর বাবা ও মামা। এই মামলায় শীঘ্রই চার্জশিট পেশ করা হবে বলে এ দিন জানিয়েছেন জলপাইগুড়ির এসপি আকাশ মেঘারিয়া। আর মেয়েটিকে খুনের মামলা সম্পর্কে প্রশ্ন করলে ময়নাগুড়ি জিআরপি-র ওসি শুভজিৎ ঝা বলেন, ‘‘আমি সবে এসেছি। মামলার সবটা না দেখে কিছু বলতে পারব না।’’
এখন কামদুনির রায় হওয়ার পরে এলাকার মানুষ আশার আলো দেখছেন। ধূপগুড়ি প্রতিবাদী নাগরিক মঞ্চের অন্যতম সদস্য অলোক চক্রবর্তী বলেছেন, “কামদুনি যদি দ্রুত বিচার পেতে পারে, তা হলে আমরা ধূপগুড়ির মানুষরা কেন পাব না?’’
কামদুনির দোষীদের মৃত্যুদণ্ডই চাইছেন ধূপগুড়ির মেয়েটির বাবা। তিনি এ দিন বলেন, ‘‘আমি চাই ওই কলেজ ছাত্রীকে খুনে অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হোক।’’ একই সঙ্গে তাঁর দাবি, ‘‘আমার মেয়েকে যারা অত্যাচার করে খুন করেছে, তারা এখন বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। উল্টে, যাঁর সাক্ষ্যে উপর নির্ভর করে অপরাধীরা শাস্তি দেওয়া যেত, তিনিও খুন হয়ে গেলেন। আর সেই খুনে কি না জেলে যেতে হল আমাকে!’’
পরিবারের বক্তব্য, ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন স্রেফ আত্মহত্যায় প্ররোচনার দায়ে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে, তা নিয়েও কলকাতা হাইকোর্টে আবেদন করা হয়েছে। বিচারের দাবি তুলে ৮ ডিসেম্বর মৃত ছাত্রীর বাবা দিল্লি গিয়ে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে স্মারকলিপিও দিয়ে এসেছেন।
এ দিন কামদুনি মামলায় রায় শোনার পরে আশায় বুক বাঁধছেন তিনি।
মেয়েটির মা-ও বললেন, ‘‘কামদুনি মামলায় কার কী সাজা হবে, তা এখনও জানা নেই। তা না শুনেও বলছি, আমার মেয়েকে যারা ধর্ষণ করে খুন করেছে, তাদের যেন ফাঁসি হয়।’’ বাবা বললেন, ‘‘খুনিরা শাস্তি না পাওয়া পর্যন্ত এক রাতও শান্তিতে ঘুমোতে পারব না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy