শুধু গ্রামীণ এলাকাতেই নয়, লোকসভা নির্বাচনে বনগাঁ শহরেও নিজেদের দাপট দেখাল বিজেপি। বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভার মধ্যে বিজেপি প্রার্থী কে ডি বিশ্বাস সব থেকে বেশি ভোটের লিড পেয়েছেন বনগাঁ উত্তর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে। বনগাঁ পুর এলাকাটি এই বিধানসভার মধ্যেই পড়ে। ২০১৫ সালে এখানে পুরভোট। তার আগে পুর এলাকায় বিজেপির বাড়-বাড়ন্ত চিন্তায় ফেলেছে তৃণমূল এবং সিপিএমকেও। প্রকাশ্যে বিজেপি নিয়ে নিজেদের উদ্বেগের কথা তারা স্বীকার না করলেও ঘরোয়া আলোচনায় ঘুরেফিরে উঠে আসছে এই প্রসঙ্গ। পুর নির্বাচনে কী ভাবে বিজেপিকে ঠেকানো যাবে, তা নিয়েও এখন থেকেই শুরু হয়েছে চিন্তা-ভাবনা।
বনগাঁ শহর তৃণমূলের সভাপতি শঙ্কর আঢ্য অবশ্য বিজেপিকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতে নারাজ। তিনি বলেন, ‘‘পুরসভার ভোট হয় স্থানীর উন্নয়নের ভিত্তিতে। গত চার বছরে এখানে যা উন্নয়ন হয়েছে, তাতে আমরা জয় নিয়ে নিশ্চিত। লোকসভা আর পুরসভার ভোট এক নয়। তা ছাড়া, বিজেপি প্রার্থীর বাড়ি এখানে হওয়ায় তিনি কিছুটা বাড়তি সুবিধা পেয়েছেন।’’ একই বক্তব্য শহর যুব তৃণমূল সভাপতি প্রসেনজিৎ ঘোষেরও। যদিও দলের এক নেতার কথায়, “পুর নির্বাচনের আগে বিজেপির এই সাফল্য আমাদের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। পুর-নির্বাচনে দলীয় টিকিট না পেয়ে অনেকেই টিকিটের লোভে বিজেপিতে যোগও দিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।’’
রাজনৈতিক মহলের একাংশ জানাচ্ছে, বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকেই এখানে পুরনো এবং নব্য তৃণমূলের মধ্যে দলের কাছে গুরুত্ব পাওয়া না পাওয়া নিয়ে অলিখিত লড়াই শুরু হয়েছিল। দলে গুরুত্ব মিলছে না, এই ক্ষোভে অনেকেই বিজেপির দিকে ঝুঁকে পড়তে পারেন। এত দিন বিকল্প হাতের কাছে না থাকায় তারা মুখ বুজে সব সহ্য করছিলেন। এই প্রবণতা ঠেকানো তৃণমূল নেতৃত্বের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ বলে দলের অনেকেই ইতিমধ্যে মনে করতে শুরু করেছেন। তা ছাড়া, নেতৃত্বের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের সুযোগও বিজেপি নিতে পারে বলে দলের কারও কারও আশঙ্কা।
বনগাঁ পুরসভার ২২টি ওর্য়াডের মধ্যে তৃণমূলের দখলে এখন ১২টি আসন। সিপিএমের ১০টি। ২০১০ সালের পুর নির্বাচনে তৃণমূল পেয়েছিল ৬টি আসন। কংগ্রেস ৫টি। নির্দল ১টি এবং সিপিএমের ছিল ১০টি আসন। নির্দল ও কংগ্রেসের সমর্থনে পুরসভা দখল করে তৃণমূল। চেয়ারম্যান হন তৃণমূলের জ্যোৎস্না আঢ্য। ভাইস চেয়ারম্যান হন কংগ্রেসের কৃষ্ণা রায়। পরবর্তী সময়ে অবশ্য নির্দল প্রার্থী ও কংগ্রেসের কাউন্সিলরেরা তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। স্বাভাবিক ভাবেই তৃণমূল নেতৃত্ব ভেবেছিলেন, কংগ্রেস কাউন্সিলরেরা দলে যোগ দেওয়ায় তাঁদের ভোটের সংখ্যা বাড়বে। কিন্তু লোকসভার ফলাফল বলছে, ২০১১ সালের বিধানসভার থেকে এ বার ভোট কমেছে শহরে। তার অন্যতম কারণ, বিজেপির আশাতীত সাফল্য। গ্রাম শহর মিলিয়ে বনগাঁ উত্তর বিধানসভায় বিজেপি প্রার্থী কে ডি বিশ্বাস এ বার পেয়েছেন ৪১,০২৬টি ভোট। যার মধ্যে শহরে তারা পেয়েছে ১৫,৯৬৫টি ভোট। বিধানসভায় শহরে তাদের ভোট ছিল ১,৪১২টি। পুরসভার ২২টি ওয়ার্ডের মধ্যে বিজেপি একটি আসন না পেলেও প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডেই তারা জাঁকিয়ে বসেছে।
যেমন ২১ ও ২২ নম্বর ওয়ার্ডের কথাই ধরা যাক। গত বিধানসভা নির্বাচনে এখানে বিজেপি প্রার্থী পেয়েছিলেন, ৭৮টি করে ভোট। এ বার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫৩ এবং ১৩৪৪টি ভোট। ১২ নম্বর ওয়ার্ডে কংগ্রেস কাউন্সিলর তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। বিধানসভায় বিজেপি পেয়েছিল মাত্র ৮৪টি ভোট। এ বার তারা পেয়েছে ৭৮৮টি ভোট। চেয়ারম্যান জ্যোৎস্না আঢ্যের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে বিজেপি পেয়েছে ৫৮০টি ভোট। বিধানসভায় ছিল হাতেগোনা ৭২টি মাত্র ভোট। এ রকম উদাহরণ প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডেই। ১৮নম্বর ওয়ার্ডে বিধানসভায় বিজেপির ভোট ছিল ৭৮টি। এ বার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮৮টিতে। তৃণমূল শহরাঞ্চলে লোকসভায় ৩০,৪৩৩টি ভোট পেয়েছে। গত বিধানসভায় যা ছিল ৩৭,৩৩৪টি ভোট। লোকসভার হিসাবে তৃণমূলের জয়ের ব্যবধান শহরে এ বার ১০,২৭২টি ভোটের। বিধানসভায় যা ছিল ১২,৭৫১।
কেন এ রকম ফল? বনগাঁ উত্তর বিধানসভার বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস অবশ্য দাবি করছেন, ‘‘শহরে তৃণমূলের ভোট তেমন কমেনি। সিপিএমের লোকেরা বিকল্প হিসাবে বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। পুরসভার ভোটে এই ফলাফলের কোনও প্রভাব পড়বে না।’’ সিপিএমের ভোট যে কমেছে, তা অবশ্য সত্যি। ১৭ নম্বর ওয়ার্ড বিধানসভায় সিপিএম পেয়েছিল ৮২৪টি ভোট। এ বার পেয়েছে ৪৪২টি ভোট। ওই ওয়ার্ডে তৃণমূল বিধানসভায় পেয়েছিল ২১২৫টি ভোট। এ বার পেয়েছে ১৯৪৮টি ভোট। দেখা যাচ্ছে, তৃণমূলের তুলনায় সিপিএমের ভোট বাক্সে বেশি আঘাত করছে বিজেপি। যদিও লোকসভার হিসাবে তৃণমূল ২২টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৭টি ওয়ার্ডে এগিয়ে। যে ৫টি ওয়ার্ডে তৃণমূল পিছিয়ে আছে, তা বিজেপির কারণেই। গত বিধানসভার তুলনায় ভোট কমেছে বামেদেরও। লোকসভার নিরিখে পুরসভায় ১০টি আসন কমে হয়েছে ৫টি। বিধানসভায় তারা পেয়েছিল ২৪,৫৮৩টি ভোট। তারা এ বার পেয়েছে ২০,১৬১টি ভোট। সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য দুলাল মণ্ডল বলেন, ‘‘বিজেপির এই উত্থানকে আমরা বিপদ হিসাবেই দেখছি।’’ গত বিধানসভায় কংগ্রেস-তৃণমূল জোট গড়ে লড়েছিল। কংগ্রেসের ৫ জন কাউন্সিলর দলে যোগ দেওয়ার পরেও কংগ্রেস শহরে পেয়েছে ২,৩৯৯টি ভোট।
কিন্তু কী ভাবে ভোট বাড়ল বিজেপির? রাজনৈতিক মহল মনে করছে, কে ডি-র বাড়ি বনগাঁ শহরে। ফলে স্থানীয় কিছু সমর্থন তিনি পেয়েছেন। তা ছাড়া, মোদী-হাওয়া তো ছিলই। মতুয়াদের দীর্ঘ দিনের ঘনিষ্ঠ কেডি মতুয়া ভোটের একটা অংশও পেয়েছেন। সর্বোপরি, স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশের প্রতি মানুষের বিরুপ মনোভাব বিজেপির বাড়বাড়ন্তের অন্যতম কারণ বলেও মনে করছেন অনেকে। কে ডি বলেন, ‘‘বনগাঁ শহরে দলীয় সংগঠন শক্তিশলী করা হবে। পুরভোটে সব ক’টি আসনেই আমরা প্রার্থী দেবো।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy