Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

প্রাচীন বাকসিহাট হারিয়েছে ঐতিহ্য, কর্তৃপক্ষ উদাসীন

এক সময়ে ধান, চাল, আলু, পাটের পাইকারি ও খুচরো বিক্রির জন্য বিখ্যাত ছিল বাগনানের বাকসিহাট। রাজ্যের অন্যতম প্রাচীন এই হাট ১৫০ বছরেরও বেশি পুরনো। একসময়ে হুগলি, মেদিনীপুর-সহ দূরবর্তী জেলা থেকে স্টিমার বোঝাই হয়ে ধান, পাট, আলু আসত এই হাটে।

এখন বাকসির হাটে চলছে জামাকাপড় কেনা বেচা।

এখন বাকসির হাটে চলছে জামাকাপড় কেনা বেচা।

মণিরুল ইসলাম
উলুবেড়িয়া শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৪ ০২:১৩
Share: Save:

এক সময়ে ধান, চাল, আলু, পাটের পাইকারি ও খুচরো বিক্রির জন্য বিখ্যাত ছিল বাগনানের বাকসিহাট। রাজ্যের অন্যতম প্রাচীন এই হাট ১৫০ বছরেরও বেশি পুরনো। একসময়ে হুগলি, মেদিনীপুর-সহ দূরবর্তী জেলা থেকে স্টিমার বোঝাই হয়ে ধান, পাট, আলু আসত এই হাটে। সেখান থেকে কলকাতা, দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বিভিন্ন জায়গায় চলে যেত তা। এ ছাড়াও ছোট ব্যবসায়ীরা সবজি, মাটির হাঁড়ি, কলসি, কুমড়ো, পান নিয়ে আসতেন দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন এলাকা থেকে। হাওড়া তো বটেই, হাট-সংলগ্ন অন্যান্য জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে আসতেন এলাকার মানুষ। কিন্তু এখন সেই দিন গিয়েছে। বাকসিহাটও এখন ভাঙা হাট।

হাওড়ার শেষ প্রান্তে রূপনারায়ণ ও মুণ্ডেশ্বরী নদীর সংযোগস্থলেই এক দিন গড়ে উঠেছিল এই হাট। নদীর পশ্চিম তীরে পশ্চিম মেদিনীপুর, সাত-আট কিলোমিটার উত্তরে হুগলি। হাওড়া, হুগলি ও মেদিনীপুরএই তিন জেলার মানুষের আনাগোনা চলত এই হাটে। পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল, দাসপুর, হুগলির নামখানা, খানাকুলের ধান, আলু, পাট, কুমড়ো নদীপথে বাকসিহাটে আসত। এ ছাড়া আমতা, জয়পুর, উদয়নারায়ণপুর এলাকার উত্‌পাদিত ফসলও ব্যবসায়ীরা এখানে নিয়ে আসতেন বিক্রির জন্য। শনিবার ও মঙ্গলবার রাতেই চলে আসতেন তাঁরা। রবিবার ও বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সেই হাট চলত। যেখানে যে পণ্য বিক্রি হত, সেখানে সেই মতো হাঁড়িহাট, পেনোহাট, মেছোহাট, ইত্যাদি নামকরণ হয় হাটের।

দেউলগ্রাম-মানকুর-বাকসি স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক তথা প্রবীণ গবেষক সত্যেন্দ্রনাথ পারিয়াল জানান, আজানগাছির জমিদার নাদের আলির সময়েই বাকসিহাটের সূচনা হয়। তার আগে ওই এলাকায় ফাঁকা মাঠ আর শ্মশান ছিল। সেখানে এক জন বাক্স তৈরি করতেন। পরবর্তী কালে নাদের সাহেবই ধীরে ধীরে সেখানে দোকান বসান। সেখান থেকেই হাটের ওই নাম হয়। ঘাটাল, হুগলি থেকে স্টিমার বোঝাই ধান নিয়ে আসা হত সাঁতরা অঞ্চলে। সেখান থেকে চাল স্টিমার বোঝাই হয়ে তমলুক বন্দর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, কলকাতা-সহ বিভিন্ন জায়গায় যেত। কথিত আছে, এক’শ বছর আগে সাঁতরা রাইস মিলের চাল বিদেশেও সুনাম অর্জন করেছিল। সুন্দর ভাবে ছাঁটাই হওয়ায় তা ব্রিটেন, জাপানেও রফতানি করা হত। এছাড়া অন্যান্য ব্যবসায়ীরা কলকাতা, তমলুক থেকে ঘাটাল যাওয়ার পথে বাণিজ্যের জন্য বাকসিতে নামতেন বলে শোনা যায়। এই ভাবেই ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করে ওই হাট। বর্তমানে এটা ওয়াকফ সম্পত্তি। নাদের আলির উত্তরসূরিরা এখন হাটের মালিক। তাঁরাই পুরো বিষয়টি দেখাশোনা করেন।

প্রাচীন এই পাইকারি হাটে দোকানপাট কমেছে অনেকটাই। ছবি: রমাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়।

হাটের এখনকার ব্যবসায়ীরা জানান, এখন আর মেদিনীপুরের ঘাটাল বা হুগলির খানাকুলের কোনও পণ্যই বাকসিতে আসে না। বরং পাঁশকুড়া, আরামবাগ বা হাওড়ার ধুলোগোড়ে চলে যায় তা। ফলে ক্রমশ ঐতিহ্য হারাতে থাকে ওই হাট। ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা। দোকান রয়েছে মোটে ২৫০টি। ব্যবসা বাণিজ্যও হয় যত্‌সামান্য। এক ব্যবসায়ী প্রদ্যুত্‌ মণ্ডল বলেন, “দীর্ঘ দিন আগে আমাদের ধান-চালের ব্যবসা ছিল। বর্তমানে সেই ব্যবসা তুলে দিয়ে চায়ের দোকান করেছি।” এলাকার ধান, চাল, আলু, পাটের ব্যবসায়ীদের একাংশ জানান, স্থানীয় চাষিদের কাছ থেকেই তাঁরা ওই সব জিনিস কিনে মজুত করে বাজারে বিক্রি করেন। ধান ব্যবসায়ীরা তা স্থানীয় মিলে পাঠিয়ে দেন। আগে হাটে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ জন পাইকারি ধান ব্যবসায়ী ছিলেন। এখন তা নেমে এসেছে ৫-৭ জনে। হাটের প্রবীণ ব্যবসায়ী ও হাট কমিটির প্রাক্তন সম্পাদক প্রতাপচন্দ্র মাহাত বলেন, “কয়েক দশক আগেও এখানে নদীর চরে রমরমিয়ে হাট বসত। কাঁচা সবজি থেকে শুরু করে ধান, পাট, আলুর লরি করে বিভিন্ন জায়গায় তা রফতানি হত। বিভিন্ন জিনিসপত্রের জন্য আলাদা আলাদা জায়গাও ছিল। এই হাটকে কেন্দ্র করে এলাকায় একটা বড় বাজারও গড়ে উঠেছিল।” কিন্তু এখন ওই হাটে কোনও শেড দেখা যাবে না। ব্যবসায়ীদেরও বসার জায়গা নেই। সবচেয়ে বড় সমস্যা হল নদীর ভাঙন। ব্যবসায়ীদের দাবি, রূপনারায়ণে হাটের প্রায় অর্ধেক অংশ তলিয়ে গিয়েছে।

কয়েক বছর আগে এলাকার বিধায়ক অসিত মিত্র হাট সংস্কার করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। বাকসি থেকে মানকুব পর্যন্ত এলাকায় বোল্ডার দিয়ে বাঁধও দেওয়া হয়। অসিতবাবু বলেন, ‘বাকসিহাট আমাদের গর্ব। সরকার এটিকে বাঁচানোর জন্য উদ্যোগী হোক। ‘হেরিটেজ’ ঘোষণা করা হোক এই হাটকে।” তাঁর মতে, এই হাটে একটা মার্কেট কমপ্লেক্স গড়ে তুললে ভাল হয়। হাট কমিটির বর্তমান সম্পাদক সজল চন্দ্র বলেন, “আমরা সীমিত ক্ষমতার মধ্যে পরিকাঠামো উন্নয়নের চেষ্টা করছি। সরকারি কোনও সহযোগিতা ছাড়া তা সম্ভব না।” কৃষি ও কৃষি বিপণনমন্ত্রী অরূপ রায় বলেন, “ওই হাটের কথা শুনেছি। তবে ওই হাটের জমির প্রকৃতি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখব। ওখানে কী করা যায়, তা নিয়ে কোনও প্রস্তাব এলে সরকার নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেবে।”

ওই হাটের মালিক নাদের আলির উত্তরসূরীদের কারওর সঙ্গে অবশ্য যোগাযোগ করা যায়নি।

অন্য বিষয়গুলি:

bakshihat hatebajare manirul islam uluberia
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE