মেদিনীপুর জেলের প্রতিমা শুকানোর কাজ চলছে। ছবি: কিংশুক আইচ
ফুটফুটে রতনের কথা বলতে গিয়ে গলা ধরে আসে চন্দনের। ৫ অক্টোবর মেয়ের বিয়ের দিনও চোখ খুঁজেছে রতনকে। সে দিন তো রতনের বয়সি ছেলেমেয়েরা এসেছিল, পড়শি বাড়িগুলো থেকে। প্রতিমা গড়ার ফাঁকে ফোনে চন্দন বলে, ‘‘কত সুন্দর দেখতে ছিল রতন। মাথা ভর্তি চুল। সারাক্ষণ হাসি লেগে থাকত মুখে। খুব ভাল ছেলে।’’
১১ বছর বয়সি রতন মাইতি খুনের মামলায় যাবজ্জীবন হয়েছে চন্দন চন্দের, ২০০৪ সালে। এ বার আলিপুর জেলে বন্দিদের পুজো, মেদিনীপুর জেলের বন্দি এবং কর্মীদের জন্য পুজোয় প্রতিমা চন্দনেরই গড়া। মেদিনীপুরের আমতলা এবং পিরাকাটায় ক্লাবের পুজোয় প্রতিমার রূপেও ভাবনা তার।
বাড়িতে অনটন, অন্য দিকে, ছবি তোলার নেশা। বাড়ি থেকে কুমোরটুলিতে পাড়ি দিয়েছিল পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতনের চন্দন। সেখানে প্রতিমা গড়ায় হাতেখড়ি। কিছু দিনের মধ্যে বাড়ি থেকে খবর এল, সাত মাসের ছেলের ধুম জ্বর! সঙ্গে বমি। তড়িঘড়ি বাড়ির পথে। আর ফেরা হয়নি। কারণ, কয়েক দিনের মধ্যেই খুনের মামলায় গ্রেফতার হয় চন্দন।
সময়টা ২০০০ সালের নভেম্বরের পড়ন্ত বিকেল। দাঁতনের কোতাইয়ে চন্দনদের দোতলা মাটির বাড়ির দালানে চলছে ‘অগ্নিশিশু ক্ষুদিরাম’ নাটকের মহড়া। ক্ষুদিরামের চরিত্রে রতন। আচমকাই রতনের গলায় পেঁচিয়ে গেল ফাঁসির দড়ি। সেই দড়ি ছাড়ানোর চেষ্টা হলেও মৃত্যু হল রতনের। অভিযোগ দায়ের হল চন্দনের বিরুদ্ধে। নাম জড়াল স্ত্রী কোকিলারও। কিছু দিনের মধ্যে স্ত্রী জামিন পেলেও পাঁচ মাস জেলে কাটিয়েছিল চন্দন। পরে জামিন পেলেও ২০০৪ সালে যাবজ্জীবন। তবে মুক্তি পান কোকিলা।
প্রথম সাড়ে তিন-চার বছর মেদিনীপুর জেলে। তারপর আলিপুর জেল। সেখানে প্রায় ১২ বছর। মাস দু’য়েক আগে মেদিনীপুর মুক্ত সংশোধনাগারে পাঠানো হয় চন্দনকে। তবে কোতাইয়ের বাড়িতে আর ফেরেনি চন্দন। দাঁতনের সনাকনিয়ার একটি ভাড়াবাড়িই আস্তানা। তিন ছেলে-মেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে ছিল সংসার। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আর কলকাতায় একটি বেসরকারি সংস্থায় রান্নার প্রশিক্ষণ নেওয়ার পাশাপাশি প্রাইভেটে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ছে চন্দনের বছর আঠারোর পুত্র। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে বলে পড়াশোনা করছে চন্দনও। জেলে থেকেই সে মাধ্যমিক পাশ ।
মেদিনীপুর মুক্ত সংশোধনাগারের অদূরে স্টুডিও চন্দনের। সহযোগী দুই বন্দি— কৃষ্ণনগরের নিমাই মণ্ডল এবং ক্যানিংয়ের ভূষণ হালদার। স্ত্রী কোকিলার হাতে তৈরি হচ্ছে পাঁচ প্রতিমার গয়না। তবে প্রতিমা গড়ার মজুরি নেয় না চন্দন। জমা দেয় কারা দফতরের ওয়েলফেয়ার ফান্ডে। বলে, ‘‘জমিজমা আছে। সংসার চলেই যায়। ওয়েলফেয়ার ফান্ডে টাকাটা দিলে বরং অন্য বন্দিদের সন্তানের পড়াশোনা টাকার অভাবে বন্ধ হবে না। আমার বেশি টাকার কী-ই বা দরকার!’’
অষ্টমীর পুষ্পাঞ্জলি নিয়েও একই কথা। গত ১৪ বছর জেলের ভিতরে অঞ্জলি দিয়েছে সে। এবার জেলের বাইরে, একটি ক্লাবের পুজোয় পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার কথা তার। কী চাইবেন দুর্গার কাছে? চন্দন বলে, ‘‘ঠাকুরের কাছে কী আর চাইব! জীবন তো শেষ হয়ে গেল। আমি বাইরে থাকলে হয়তো ছেলেমেয়ে আরও পড়াশুনো করতে পারত। শুধু বলব, সকলে ভাল থাকুক।’’ এই ‘সকলে’র মধ্যে রয়েছে রতনের পরিবারও। চন্দনের কথায়, ‘‘রতনের পরিবারের লোকদের সঙ্গে দেখা হয়। খুব ভাল পরিবার। কখনওই খারাপ ব্যবহার করে না। আমারই কপালে ছিল মামলায় জড়ানো!’’
রতনের আত্মীয়, খোকন মাইতি বলেন, ‘‘আমরা খারাপ ব্যবহার করব কেন? কিন্তু মন থেকে কি মেনে নেওয়া যায়! সুপ্রিম কোর্ট থেকে যদি নিজেকে ছাড়িয়ে আনতে পারে পারুক। মুখে অনুশোচনা আর কাজে করা, এক নয়।’’
আর চন্দন মুখে রতনের কথাই বলে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy