গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সিপিআই থেকে সিপিএম তৈরির পরে ৬০ বছর কাটতে চলল। এখনও এক বারও ‘বাঙালি’ সাধারণ সম্পাদক পায়নি দল। এ বার কি সেই ধারা বদলাতে চলেছে? ঘটনাপ্রবাহ সে দিকেই ইঙ্গিত করছে।
সীতারাম ইয়েচুরির মৃত্যুর পরে আগামী ছ’মাসের জন্য সিপিএম কাউকে ‘ভারপ্রাপ্ত’ সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়নি। ঠিক হয়েছে, আগামী এপ্রিলে অনুষ্ঠিতব্য পার্টি কংগ্রেস পর্যন্ত সামগ্রিক ভাবে পলিটব্যুরো যৌথ ভাবে দায়িত্ব সামলাবে। তবে ‘সমন্বয়ক’ হিসাবে কাজ করবেন প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট। এর পরেই দলে আলোচনা শুরু হয়েছে, কেন কাউকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক না করে ‘সমন্বয়ক’ করা হল? সিপিএমের সর্বোচ্চ সূত্রের খবর, দলের পলিটব্যুরোর সদস্য তথা পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমকে ভাবার জন্য সময় দেওয়া হয়েছে। রাজি হলে তিনিই হবেন পরবর্তী সাধারণ সম্পাদক। তা হলে ইতিহাসে প্রথম বার সিপিএম এক ‘বাঙালি’ সাধারণ সম্পাদক পাবে।
কিন্তু সেলিম কি রাজি হবেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অনেকেই সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করছেন। দিল্লির এমসে চিকিৎসাধীন সীতারামের শারীরিক অবস্থা তখন অতি সঙ্কটজনক। সিপিএম সূত্রে খবর, সেই সময়েই কারাট বার্তা পাঠিয়েছিলেন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে। সেই বার্তা ছিল এই যে, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সম্পাদক সেলিম দিল্লিতে গিয়ে আপাতত পার্টিকেন্দ্রের হাল ধরুন। কিন্তু তখন সেলিম বাংলা ছাড়তে রাজি হননি। গত শুক্র ও শনিবার সিপিএমের পলিটব্যুরোর বৈঠক ছিল। তার আগে সেলিমকে রাজি করানোর আরও এক দফা চেষ্টা করেছিলেন কারাটেরা। সিপিএম সূত্রের খবর, সেলিম আবার অন্তর্বর্তী সাধারণ সম্পাদক হওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু পলিটব্যুরো এখনও আশা ছাড়তে রাজি নয়।
এই প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে সেলিম কোনও মন্তব্য করেননি। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, ‘‘সেলিমদাকে ২০১২ সালে দিল্লিতে পার্টিকেন্দ্রে কাজ করতে বলেছিল দল। কিন্তু তিনি সেই সময়েই বলে দিয়েছিলেন, তিনি বাংলাতেই পার্টি করবেন।’’ তবে ‘পরিবর্তিত’ পরিস্থিতিতে সেলিমকেও যে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হচ্ছে, তা-ও মানছেন অনেকে। পলিটব্যুরোর একটা বড় অংশ সেলিমকে চাইছে বলে খবর। কারণ, সংসদীয় রাজনীতিতে সেলিমের অভিজ্ঞতা রয়েছে। দু’বার রাজ্যসভা এবং দু’বার লোকসভার সাংসদ ছিলেন তিনি। রাজ্যে কয়েক বছর মন্ত্রীও ছিলেন। ছিলেন দলের যুব সংগঠনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে। ফলে দেশের সব রাজ্য তাঁর চেনা। তা ছাড়া সর্বভারতীয় স্তরে কোনও দলের সর্বোচ্চ নেতা হতে গেলে একাধিক ভাষা জানাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেলিম বাংলার পাশাপাশিই ইংরেজি, হিন্দি এবং উর্দুতে সাবলীল। অনর্গল বলে যেতে পারেন। সিপিএমের পরবর্তী সাধারণ সম্পাদক হওয়ার ক্ষেত্রে আর যাঁদের নাম বিবেচনার মধ্যে রয়েছে, তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই দক্ষিণ ভারতের নেতা। হিন্দি, উর্দু বলা বা বোঝার ক্ষেত্রে তাঁদের ‘সীমাবদ্ধতা’ রয়েছে।
বয়সের কারণেও পলিটব্যুরোর অনেকে সেলিমকে চাইছেন। সিপিএম এখন নিয়ম করেছে, ৭৫-এর ঊর্ধ্বে কাউকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে রাখবে না। পাশাপাশিই দলে এই নিয়মও চালু হয়েছে যে, এক ব্যক্তি একটি স্তরে তিনটি মেয়াদের বেশি সম্পাদকের দায়িত্ব সামলাতে পারবেন না। যে কারণে তিনটি মেয়াদের পরে কারাট সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সরে গিয়েছিলেন ২০১৫ সালে। আগামী পার্টি কংগ্রেসে সীতারামেরও তৃতীয় মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার কথা ছিল। যদিও সীতারাম থাকাকালীনই দলে আলোচনা শুরু হয়েছিল, দলের তিন-চতুর্থাংশের সমর্থন নিয়ে ফের তাঁকেই সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া যায় কি না। কিন্তু সেই সুযোগ আর নেই।
দলের এক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যের কথায়, ‘‘এমন কাউকে দল সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিতে চায়, যিনি তিনটি মেয়াদের দায়িত্ব সামলাতে পারেন। সেলিমের বয়স সেই মাপকাঠিতে মিলে যাচ্ছে।’’ সেলিমের বয়স এখন ৬৭ বছর। ৭৫ হতে এখনও আট বছর বাকি। সিটুর এক সর্বভারতীয় নেতা বলেন, ‘‘সেলিমদা দায়িত্ব নিতে রাজি হলে তিনি তিনটি মেয়াদ সাধারণ সম্পাদক থাকতে পারেন।’’ অন্য দিকে, আর যাঁদের সম্ভাবনা রয়েছে, সেই এমএ বেবি, বিভি রাঘভূলুর বয়স এখনই ৭০ পেরিয়েছে। ফলে তাঁরা কেউই তিন মেয়াদ অর্থাৎ ন’বছর সাধারণ সম্পাদক থাকতে পারবেন না। আবার সেলিমের আশপাশে যাঁর বয়স রয়েছে, কেরলের নেতা সেই এ বিজয়রাঘবন ২০২২ সালেই প্রথম বার পলিটব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। সে দিক দিয়ে তিনি ‘জুনিয়র’। এ হেন সাতসতেরো ভেবেই সেলিমকে দায়িত্ব নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের একটি বড় অংশ। সেলিম রাজি না হলেও তাঁকে রাজি করানোর ধারবাহিক চেষ্টা জারি রাখতে চায় সিপিএমের বড় অংশ। সূত্রের খবর, সেই ‘বোঝাপড়া’ থেকেই কাউকে ‘ভারপ্রাপ্ত’ সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব না দিয়ে ‘সমন্বয়ক’ করা হয়েছে কারাটকে।
১৯৬৪ সালে সিপিএম তৈরি হওয়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত এমনটা ঘটেনি যে সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন কোনও নেতা প্রয়াত হয়েছেন। ফলে অতীতে সিপিএমকে এই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়নি। সিপিএমের বিভিন্ন স্তরে কোনও সম্পাদকের অসুস্থতা, প্রয়াণ ইত্যাদির পরে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক করারই রেওয়াজ রয়েছে। তবে পার্টি কংগ্রেস যখন দোরগোড়ায়, তখন আর কাউকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিল না তারা। সিপিএমের এক নেতার কথায়, ‘‘নতুন কাউকে দায়িত্ব দিলে দলে ধারণা তৈরি হয়ে যেত যে, তিনিই পরবর্তী সাধারণ সম্পাদক। ফলে পার্টি কংগ্রেস সম্পর্কে আর ততটা আগ্রহ থাকত না। তেমনটা ঘটলে সেলিমকে বোঝানোর রাস্তা বন্ধ হয়ে যেত। তাঁকে ভাবতে সময় দেওয়াও যেত না। এ ক্ষেত্রে একটা সুযোগ অন্তত রইল।’’
রাজ্য সিপিএমে সেলিমকে যাঁরা পছন্দ করেন, তাঁদের মধ্যে দু’রকম মতামত রয়েছে। একাংশ চায়, সেলিম সাধারণ সম্পাদক হন। দল বাঙালি সাধারণ সম্পাদক পাক। অন্য বড় অংশ আবার চায়, সেলিম যেন বাংলার দায়িত্ব ছেড়ে না যান। তা হলে মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়দের মতো কম বয়সি নেতানেত্রীরা পার্টিতে ‘অনাথ’ হয়ে পড়বেন। কারণ, সেলিম যে ভাবে তরুণ প্রজন্মকে নেতৃত্বে তুলে আনতে চান, তা অন্য অনেক নেতার ক্ষেত্রে দেখা যায় না। তাঁরা এ বিষয়ে কিছুটা ‘রক্ষণশীল’।
শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেবেন সেলিম নিজেই। তাঁর ঘনিষ্ঠ এক নেতা সোমবার রসিকতা করে বলছিলেন, ‘‘সেলিমদার কানে এখন এখন ঋত্বিক ঘটকের কথাটা বাজবে— ভাবো ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy