প্রতীকী চিত্র।
ধর্মঘটের হাতিয়ার হাতছাড়া করার কথা আসছে না ঠিকই। কিন্তু এ বারের ২ সেপ্টেম্বর সিপিএমের অন্দর মহলে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে সাধারণ ধর্মঘটের কার্যকারিতা নিয়ে।
শ্রমিকদের কথা মাথায় রেখেই ১৪ দফা দাবিতে এ বার দেশ জু়ড়ে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি। এ রাজ্যে বামফ্রন্ট ও তার বাইরে মিলিয়ে মোট ১৭টি দল ধর্মঘটকে সমর্থন করেছিল। রাজ্য প্রশাসনের কড়া ব্যবস্থা, শাসক দলের চোখরাঙানির মধ্যেও ধর্মঘট ছাপ ফেলেছে বলে বাম নেতাদের দাবি। কিন্তু ঘরোয়া আলোচনায় তাঁরা এটাও মানছেন, কাঙ্খিত পর্যায়ে পৌঁছয়নি ধর্মঘটের ‘সাফল্য’ বা প্রভাব। এবং এখান থেকেই সূত্রপাত বিতর্কের। সাধারণ ভাবে ধর্মঘট হয় মূলত দু’ধরনের। কোনও ঘটনার প্রতিবাদে এক ধরনের ধর্মঘট। আর এক রকমের ধর্মঘট হয় নির্দিষ্ট দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য, অনেক আগে থেকে ঘোষণা করে। এ বারের ধর্মঘট ছিল এই দ্বিতীয় পর্যায়ের। এক দিকে খাস কলকাতাতেই ব্র্যাবোর্ন রোডের ফুটপাথ থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে এক কিশোরীকে। সেই ঘটনার প্রতিবাদে চোখে পড়ার মতো কিছুই প্রায় করতে দেখা যায়নি বামপন্থীদের। প্রতিবাদের এমন বিষয় যখন অবহেলায় পড়ে রইল, সেই সময়েই শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে ধর্মঘট সাদামাঠা ভাবে পেরিয়ে যাওয়া ভাবতে বাধ্য করছে সিপিএমের একাংশকে। ধর্মঘট কখন কী বিষয়ে ডাকা হবে, তা নিয়ে নতুন করে ভেবে দেখার পক্ষপাতী এই অংশ।
সিপিএম নেতাদেরই একাংশ বলছেন, ফি বছর ট্রেড ইউনিয়নগুলি যে দাবিদাওয়া নিয়ে ধর্মঘটে যাচ্ছে, সেগুলি অবশ্যই ন্যায্য। কিন্তু এ সব দাবি কারখানার শ্রমিক, অসংগঠিত মজুর বা রাষ্ট্রায়ত্ত নানা ক্ষেত্রের কর্মচারীদের কেন্দ্র করে। সাধারণ, মধ্যবিত্ত মানুষ এর সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে একাত্ম হতে পারছেন না। তাই সরকারের চাপ ধর্মঘটে ভাঙন ধরাতে সফল হয়ে যাচ্ছে। কোনও ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে বড় কর্মসূচি নিলে যে ভাবে আম জনতাকে সামিল করা যায়, এই ধরনের ধর্মঘটে ঠিক সে ভাবে সমর্থন আদায় করা মুশকিল— প্রকাশ্যে না বললেও ঘরোয়া আলোচনায় মানছেন দলের নেতাদের কেউ কেউ। সিপিএমেরই এক রাজ্য কমিটির সদস্যের কথায়, ‘‘খুব ভাল করে চিন্তা করলে দেখা যাবে, এই ধর্মঘটের চরিত্রটা ছিল শিল্প ধর্মঘটের মতো। যে সব ক্ষেত্রের সমস্যা বা দাবি নিয়ে ধর্মঘট, সেখানেই এর এক্তিয়ার সীমাবদ্ধ রাখলে বোধহয় ভাল হয়। এটা নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করা দরকার।’’ সাধারণ ধর্মঘটের ঠিক আগে দিল্লি থেকে ট্রেনে ফিরছিলেন এক বাম সাংসদ। কলকাতার শহরতলির এক বাসিন্দা পরিচয় করে তাঁকে জানিয়েছেন, ওই ধর্মঘটের দাবি যুক্তিযুক্ত ছিল। কিন্তু তিনি যে ধরনের কাজ করেন, সেখানে দৈনিক ভিত্তিতে বেতনের হিসাব হয়। ধর্মঘটের দাবিপূরণ হলেও তাঁর নিজের কিছু এসে যাবে না। তাই দাবিগুচ্ছকে সমর্থন জানিয়েও ধর্মঘটে অংশ নিতে পারছেন না। মানুষের এই মনোভাবকেই আরও বৃহত্তর প্রেক্ষিতে বিচার করে তবে ধর্মঘটের পথে যাওয়ার কথা ভেবে দেখতে বলছেন সিপিএমের একাংশ।
ধর্মঘট নিয়ে সিপিএমের অন্দরে বিতর্ক অবশ্য নতুন নয়। মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন শিল্পায়নের কর্মসূচি নিয়ে এগোনোর সময়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এক বার বণিকসভার একটি অনুষ্ঠানে মন্তব্য করে ফেলেছিলেন, দুর্ভাগ্যবশত তিনি এমন একটি দল করেন, যারা ধর্মঘট ডাকে! বিতর্কের মুখে তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, ওই কথা বলতে চাননি। পরে রাজ্য সম্মেলনের মঞ্চে এই নিয়ে খোলাখুলি ভুল স্বীকার করেছিলেন বুদ্ধবাবু। প্রতাপ কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিটুও এখন ঘন ঘন ধর্মঘটের পথ থেকে সরে এসেছে। তবে প্রকাশ্যে তারা এখনও ‘বাধ্য হয়ে ধর্মঘট’ ডাকার পক্ষেই যুক্তি দিচ্ছে। এ বারই যেমন সংগঠনের রাজ্য সভাপতি শ্যামল চক্রবর্তী বলেছেন, ‘‘দৈনিক মজুরদের রোজগার মাটি হবে বলে যাঁরা ধর্মঘটের দিন লিটার লিটার চোখের জল ফেলেন, অন্য দিনের কথা তাঁরা কি ভাবেন? প্রতিবাদের ফলে যে মজুরি বেড়েছে, তাতে এক দিনের ক্ষতি বাড়তি মজুরির জন্য আড়়াই দিনে পূরণ হয়ে যাবে।’’
মধ্য কলকাতার ধর্ষণ-কাণ্ডে মহিলা সমিতি প্রতিবাদে নেমেছে বলে সিপিএম নেতৃত্বের দাবি। কিন্তু যে প্রতিবাদ টেরই পাওয়া যায় না আর যে কর্মসূচিতে আম জনতাকে সহজে কাছে পাওয়া যায় না, সেই বাঁধা গত ছেড়ে বেরোনো হবে কবে? প্রশ্ন এখন দলের অন্দরেই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy