সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত যাতে সিবিআইয়ের হাতে না-যায় তার জন্য রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত লড়েছিল তাঁরই নির্দেশে। বছর দুয়েক আগে বারাসতের কামদুনিতে এক কলেজছাত্রীকে গণধর্ষণ করে খুনের পরে স্থানীয় মানুষ যখন সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়েছিলেন, তা-ও তৎক্ষণাৎ নস্যাৎ করে দিয়েছিল নবান্ন, তাঁরই নির্দেশে। বীরভূমের পাড়ুইয়ে সাগর ঘোষ হত্যার তদন্ত সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার আর্জি জানিয়ে তাঁর পরিবার যে মামলা লড়ছে, সুপ্রিম কোর্টে তারও বিরোধিতা করছে রাজ্য।
এ হেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই বুধবার রানাঘাটের কনভেন্ট স্কুলে ডাকাতি ও মাদার সুপিরিয়রকে ধর্ষণের ঘটনার তদন্তভার তুলে দিলেন সিবিআইয়ের হাতে। ফেসবুক ও টুইটারে তাঁর ঘোষণা: ‘রানাঘাটে ১৪ মার্চের ঘটনাটি অত্যন্ত গুরুতর। পুলিশ-প্রশাসনকে দ্রুত অপরাধীদের ধরার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তারা সর্বতোভাবে চেষ্টা করছে। তবে ঘটনার গুরুত্ব, স্পর্শকাতরতা বিবেচনা করে এবং ঘটনাস্থল সীমান্তবর্তী এলাকায় হওয়ায় আমি তদন্তভার সিবিআইকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের সরকার তদন্তে সব রকমের সহযোগিতা করবে।’
অথচ, অসম, ওড়িশা-সহ একাধিক রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সিবিআইয়ের হাতে যাওয়ার পরে মমতার নির্দেশে পথে নেমেছিল তৃণমূল। কলকাতায় সিবিআই দফতরের সামনে ধর্নায় বসেছিলেন খোদ রাজ্যের আইনমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী নিজে সিবিআই-কে নস্যাৎ করে বলেছিলেন, “সুপ্রিম কোর্ট বলেছে সিবিআই তোতাপাখি। তোতাপাখি কীসের তদন্ত করবে!... ছোট আঙারিয়া থেকে শুরু করে নেতাই পর্যন্ত অনেক ঘটনার তদন্ত করেছে সিবিআই। কোনওটার সমাধান হয়েছে? সিবিআই নোবেল চোর ধরতে পেরেছে?”
বাম আমলে প্রায় প্রতিটি ঘটনা নিয়ে সিবিআই তদন্তের দাবি তোলা মমতার এই মন্তব্য নিয়ে সরব হন বিরোধীরা। তাঁদের অভিযোগ ছিল, সারদা কেলেঙ্কারিতে তৃণমূলের একের পর এক নেতা-মন্ত্রী গ্রেফতার হচ্ছেন বলেই মুখ্যমন্ত্রী এমন অগ্নিশর্মা। সেই কারণেই এখন তাঁর সিবিআইয়ের উপরে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের কথা মনে হচ্ছে। তিনি বলছেন, “সিবিআই কখনও কংগ্রেস ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন। কখনও অন্য কিছু। ওরা কেমন তদন্ত করে জানা আছে।”
কিন্তু রানাঘাটের ঘটনা নিয়ে তাঁর সরকারের উপরে দেশ-বিদেশের চাপ যখন প্রতিদিন বাড়ছে, ঘটনার পাঁচ দিন পরেও যখন এক জন দুষ্কৃতীকেও গ্রেফতার করতে পারেনি তাঁর পুলিশ, তখন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সেই সিবিআইয়েরই শরণাপন্ন হলেন মমতা। যে সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দিয়ে পরে নবান্নে সাংবাদিক বৈঠকে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, “হতে পারে অপরাধীরা ভিন্ রাজ্যে বা ভিন্ দেশে পালিয়েছে। সে ক্ষেত্রে রাজ্য পুলিশের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অন্য দিকে সিবিআইয়ের পরিধি বড়। ওই ঘটনার সঠিক বিচার দিতেই সরকার সিবিআই তদন্ত চাইছে।” প্রশ্ন ছিল, তা হলে কি রাজ্য পুলিশ তদন্তে ব্যর্থ? জবাব এড়িয়ে ফিরহাদ বলেন, “অন্য রাজ্যের অনেক অপরাধের তদন্ত সিবিআই-কে দেওয়া হয়। তা হলে কি সে সব ক্ষেত্রে সে রাজ্যের পুলিশ ব্যর্থ?”
প্রশাসনের একটা অংশ বলছে, সারদা কেলেঙ্কারিতে সিবিআই-কে আক্রমণ করে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করতে চেয়েছিলেন মমতা। আবার রানাঘাটের ঘটনায় সেই সিবিআই-কে ডেকে তাঁর লক্ষ্য, রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে যে সমালোচনার ঝড় উঠেছে, তা খানিকটা হলেও কেন্দ্রের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া। কারণ এ বার কিছু করে দেখানোর দায় বর্তাবে কেন্দ্রের উপরে। কিছুটা আড়ালে চলে যাবে রাজ্য পুলিশের ব্যর্থতার প্রসঙ্গ। দু’দিন আগেই নবান্নে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, তিনি রাজ্য পুলিশের সেরা দলকে রানাঘাটে নামিয়েছেন। দ্রুত আসল অপরাধীদের গ্রেফতার করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাদের। কিন্তু পাঁচ দিনেও তারা সাফল্যের মুখ দেখেনি। কাউকে গ্রেফতার করা দূরস্থান, কার্যত অন্ধকারে হাতড়েচলেছে তারা। যার জেরে ক্রমশ ক্ষোভ বেড়েছে সাধারণ মানুষের। সোমবার রানাঘাটে গিয়ে যার আঁচ পেয়েছিলেন খোদ মমতা। সেই ক্ষোভ ঠেকানোর ঢাল হিসেবে তিনি হাতে তুলে নিলেন সিবিআই-কে। ক’দিন আগেই যে গোয়েন্দা সংস্থা থাকার কোনও দরকার আছে কি না, তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি।
তবে শুধু সাধারণ মানুষের ক্ষোভ নয়, খ্রিস্টান সম্প্রদায় এবং কেন্দ্রীয় সরকারের তরফেও চাপ বাড়ছিল মমতার উপরে। তৃণমূলের একটি সূত্র বলছে, বিজেপির উত্থানের পরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটের উপরে প্রবল ভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন মমতা। কিন্তু তাঁর নিজের রাজ্যেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক বৃদ্ধ সন্ন্যাসিনীর উপরে যৌন নির্যাতন হল এবং তাঁর পুলিশ কিছুই করতে পারল না এই ব্যর্থতার দায়ভার যে কোনও উপায়ে ঝেড়ে ফেলতে চাইছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তার উপরে সোমবার রানাঘাটে অবরুদ্ধ হওয়ার জন্য মমতা বিজেপি-কে দায়ী করায় নড়েচড়ে বসেছিল দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। সন্ন্যাসিনীর ধর্ষণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে রাজ্যের কাছে রিপোর্ট চেয়ে পাঠান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এ দিন বেলা ১২টা নাগাদ প্রধানমন্ত্রী সচিবালয় থেকে সেই চিঠি এসে পৌঁছয় নবান্নে। জানতে চাওয়া হয়, রাজ্য কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে, এর পর কী পদক্ষেপ করা হবে। আর তার পরেই কেন্দ্রের কোর্টে বল ফিরিয়ে দেন মমতা। প্রশাসনিক কর্তাদের অনেকে বলছেন, এ বার তদন্তে নেমে সিবিআই হোঁচট খেলে পাল্টা সমালোচনা করতে পারবে রাজ্য সরকার।
সরকারি ভাবে অবশ্য এ সব কোনও কারণই তুলে ধরা হচ্ছে না। বরং বলা হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী যে দিন রানাঘাটে গিয়েছিলেন সে দিনই স্থানীয় মানুষ তাঁর কাছে সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়েছিলেন। তাঁদের দাবি মেনেই ওই কেন্দ্রীয় সংস্থার হাতে তদন্তের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হল। এ দিনই বিকেলের দিকে ওই আর্জি জানিয়ে দিল্লিতে চিঠি পাঠিয়েছে রাজ্য সরকার।
অন্য দিকে সরকারি যুক্তি উড়িয়ে বিরোধীদের অভিযোগ, পুরভোটের আগে চাপের মুখে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মমতা। দু’দিন আগেই রানাঘাটে গিয়ে তিনি কনভেন্টের ছাত্রছাত্রী-অভিভাবক এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের বিক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন। এই ঘটনায় দুনিয়া জুড়ে যখন বিতর্ক দানা বেধেছে, তখন মমতা বাধ্য হলেন তদন্তের ভার সিবিআই-কে দিতে। বিজেপি রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, “ঘটনার পরেই আমরা সিবিআই তদন্ত চেয়েছিলাম। কিন্তু সরকার সিআইডিকে দিয়ে তদন্ত করার কথা বলে। সিবিআই তদন্তেই প্রমাণ হবে কারা ঘটনার নেপথ্যে।”
দোষীদের গ্রেফতারের দাবিতে রাজ্য নির্বাচনী দফতরের সামনে বামফ্রন্টের অবস্থানের পরে এ দিন এন্টালি পর্যন্ত মোমবাতি-মিছিল বার হয়। অবস্থান মঞ্চে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “টুইট করে তো সিবিআই হয় না! উনি (মুখ্যমন্ত্রী) কি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সঙ্গে কথা বলে টুইট করেছেন? যত ক্ষণ না সিবিআই আসছে, তত ক্ষণ কি সিআইডি পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে?” তাঁর আরও প্রশ্ন, “ঘটনার পরে যে পুলিশ তিন দিন ধরে ঘুমিয়ে ছিল, তাদের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রী কী ব্যবস্থা নেবেন?” তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য পাল্টা বলেন, “৩৪ বছরের বাম রাজত্বেই পুলিশকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতেন সূর্যবাবুরা।”
প্রতিবাদের মুখ। বিজেপি মহিলা মোর্চার মিছিলে অঞ্জনা বসু ও লকেট চট্টোপাধ্যায়। বুধবার ধর্মতলায়। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেন, “বিশ্ব জনমত, আর্চবিশপের মতামতের পরে মুখ্যমন্ত্রীকে মাথা নত করতে হয়েছে। কারণ, দিল্লি ইতিমধ্যেই রিপোর্ট চেয়েছে।” এ দিন বামপন্থী মহিলা সংগঠনের তরফেও কলেজ স্কোয়ার থেকে লেনিন সরণির ইউনিয়ন চ্যাপেল পর্যন্ত মিছিল করা হয়।
তৃণমূল অবশ্য এ দিন অযাচিত ভাবেই পাশে পেয়েছে দলে কোণঠাসা সাংসদ মুকুল রায়কে। সাম্প্রতিক অতীতে প্রায় প্রত্যেকটি বিষয়েই দলীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কথা বলা মুকুল এ দিন বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছি। এই তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy