এক দিন বণিকের মানদণ্ড নিয়ে ভারতে প্রবেশ করে এই বাংলা থেকেই রাজদণ্ড হাতে তুলে নিয়েছিল ব্রিটিশেরা। সেই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাণিজ্যের মানদণ্ড নিয়ে বিলেতে। মঙ্গলবার ব্রিটিশ বণিকমহলের সামনে তিনি পশ্চিমবঙ্গের শিল্পবান্ধব পরিবেশকে বিপণনের চেষ্টা করলেন। সাড়াও পেলেন ইতিবাচক। শুধু বিনিয়োগের ডাক নয়, মমতার বক্তৃতায় রইল বেশ কিছু পরিসংখ্যান। ব্রিটেনের বণিকমহলের উদ্দেশে মমতা বলেন, ‘‘কেন আপনারা বিনিয়োগের জন্য বাংলাকে বেছে নেবেন? কারণ, বাংলায় টেনশন নেই, স্ট্রেস নেই। ভারতে যেখানে জিডিপি বৃদ্ধির হার ৬.৩৭ শতাংশ, বাংলায় তা ৬.৮০ শতাংশ। সর্বত্র যখন বেকারত্ব বাড়ছে, তখন বাংলায় তা ৪৭ শতাংশ আমরা কমাতে পেরেছি।’’
আকারে ছোট হলেও মঙ্গলবারের কর্মসূচি ছিল একটি বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন। গত ৫ এবং ৬ ফেব্রুয়ারিতে কলকাতার সম্মেলনের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে মমতার ভাষণে। এসেছে ডেউচা-পাঁচামির কথাও। মমতা বলেছেন, ‘‘ডেউচার কাজ শেষ হলে আগামী ১০০ বছর বিদ্যুৎ নিয়ে কোনও চিন্তা থাকবে না।’’ বাংলার মানুষের জীবযাপনের মানের উন্নতির তথ্য দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘২০১১ সালে আমরা যখন সরকারে এসেছিলাম, তখন দারিদ্র্যসীমার নীচে ছিলেন ৫৭ শতাংশ মানুষ। আজ তা কমে ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।’’
যে কোনও বিনিয়োগকারীর কাছেই পরিবেশ, শ্রমিকের মান এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ সূচক। সেই তিন সূচকের কথাই মমতা উল্লেখ করেছেন ব্রিটেনের বাণিজ্য বৈঠকে। বাম সরকারের সময়ের ধর্মঘটের সংস্কৃতির কথা উল্লেখ করে মমতা বলেছেন, ‘‘আগের সরকারের সময়ে ধর্মঘটের কারণে অনেক কর্মদিবস নষ্ট হত। কিন্তু আমরা বন্ধের সংস্কৃতিই বন্ধ করে দিয়েছি। এখন আর বাংলায় কোনও শ্রমদিবস নষ্ট হয় না।’’ নির্দিষ্ট কাজের জন্য দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার যে ভাবে আইটিআই, পলিটেকনিক তৈরি করেছে, সেই পরিসংখ্যানও দেন মমতা। পাশাপাশি উল্লেখ করেন, আরও বিনিয়োগ টানার লক্ষ্যে রাজ্যে ছ’টি শিল্প করিডর তৈরি হচ্ছে। রাজ্য বাজেটে সেই করিডর নির্মাণের জন্য অর্থের সংস্থানও রেখেছে রাজ্য সরকার। বাজার সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের আরও একটি আগ্রহ কাজ করে। তা হল সংশ্লিষ্ট বাজারে নগদের লেনদেন কেমন রয়েছে। সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের কথা উল্লেখ করে মমতা বলেন, ‘‘বাংলায় ক্যাশ ফ্লোয়ের কোনও সঙ্কট নেই।’’
তুখোড় রাজনীতিক এবং প্রশাসক হলেও মমতার একটা মিঠে এবং অন্তরঙ্গ ব্যক্তিত্ব আছে। ইংরেজরা বলবেন ‘চার্মিং’। বক্তৃতার সময় সেটা তিনি অকাতরে বিলিয়ে যান। লন্ডনের শিল্প সম্মেলনেও তার অন্যথা হল না। মমতার লন্ডন সফরে বিঘ্ন ঘটিয়েছিল হিথরো বিমানবন্দরে বিদ্যুৎ বিপর্যয়। গত শনিবার সকালের বদলে সন্ধ্যার বিমানে রওনা দিতে হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীকে। যার ফলে এই সফরও খানিক ধকলের হয়েছে। সোমবার ভারতীয় হাই কমিশনের অনুষ্ঠানে মমতা হাই কমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামীর মাধ্যমে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ়ের কাছে কলকাতা-লন্ডন সরাসরি উড়ান চালানোর আর্জি জানিয়েছিলেন। মঙ্গলবারের শিল্প সম্মেলনে সেই সংস্থার প্রতিনিধিকে সামনে পেয়ে তাঁর কাছেও আর্জি জানালেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। অন্তরঙ্গ এবং মিঠে ভাবেই মমতা ঘোষণা করে দিলেন, যে সংস্থা আগে এই পরিষেবা শুরু করবে, তাদের রাজ্য সরকার ছাড় দেবে। রাজকীয় অভ্যর্থনাও জানাবে। মমতা লন্ডনে যে হোটেলে উঠেছেন, সেই সেন্ট জেমস কোর্টের ১ নম্বর এডওয়ার্ডিয়ান হলে অনুষ্ঠিত হল বাণিজ্য বৈঠক।
বৈঠকের শুরুতে ‘বদলে যাওয়া বাংলা’ এবং সেই বাংলায় শিল্পবান্ধব পরিবেশের কথা তুলে ধরেন মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ। ছিলেন ইউকে ইন্ডিয়া বিজনেস কমিউনিটির চেয়ারম্যান রিচার্ড হিল্ড, ফিকির প্রেসিডেন্ট হর্ষবর্ধন আগরওয়াল। উল্লেখযোগ্য উপস্থিতির মধ্যে রয়েছেন লর্ড স্বরাজ পল। হুইল চেয়ারে বসেই সম্মেলনে এসেছিলেন তিনি। গোটা বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন শিল্পসচিব বন্দনা যাদব।
সোমবার ব্রিটেনের হাই কমিশনে আমন্ত্রিত ছিলেন মমতা। মঙ্গলবারের শিল্পবৈঠকে মঞ্চে ছিলেন ভারতীয় হাই কমিশনার দোরাইস্বামী। হাই কমিশন এ বার যে ভাবে একটি অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর প্রয়াসকে সমর্থন করছে— এই দৃষ্টান্ত স্মরণকালের মধ্যে দেখা যায়নি। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে কবে দেখা গিয়েছে, কেউ মনে করতে পারছেন না। দোরাইস্বামী যে ভাবে বলেছেন, ‘‘হাই কমিশনের তরফে আমরা পশ্চিমবঙ্গের উন্নতিতে অংশীদার হতে চাই’’, তার নজির আছে বলে কেউ মনে করতে পারছেন না। বিশেষত, যখন রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে ‘রাজনৈতিক দূরত্ব’ সর্বজনবিদিত।
ব্রিটিশ বণিকমহলের সামনে বাংলার কথা তুলে ধরেন একাধিক শিল্পপতি। প্রতিনিধি দলে ছিলেন, ধানসেরি ভেনচার্সের এগ্জ়িকিউটিভ চেয়ারম্যান চন্দ্র কুমার ধানুকা, অম্বুজা নেওটিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান হর্ষ নেওটিয়া, গ্রাফিতি ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান কেকে বাঙুর, টেগা ইন্ডাস্ট্রিজ়ের মেহুল মোহানকা, শ্রী সিমেন্টের ভাইস চেয়ারম্যান তথা বাংলায় ফিকির চেয়ারম্যান প্রশান্ত বাঙুর, জিইইসিএলের ভাইস চেয়ারম্যান তথা এমডি প্রশান্ত মোদী, লক্ষ্মী গ্রুপের চেয়ারম্যান রুদ্র চট্টোপাধ্যায়, প্যাটন ইন্টারন্যাশনালের এমডি সঞ্জয় বুধিয়া, সিস্টার নিবেদিতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য সত্যম রায়চৌধুরী, আরপি সঞ্জীব গোয়েন্কা গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান শাশ্বত গোয়েন্কা, রিলায়্যান্স ইন্ডাস্ট্রিজ়ের প্রেসিডেন্ট তরুণ ঝুনঝুনওয়ালা, জেনেসিসের কর্ণধার উজ্জ্বল সিন্হা, টিটাগড় রেলওয়ে সিস্টেমের এমডি উমেশ চৌধুরী, ফিকির ডিজি জ্যোতি ভিজ, ফিকির ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল মৌসুমী ঘোষ।
সব মিলিয়ে ১৫০ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন মমতা আহূত বাণিজ্য বৈঠকে। ব্রিটেনের আর্থিক পরিষেবা সংক্রান্ত সংস্থা ছাড়াও প্রযুক্তি, শক্তি, উৎপাদন, খুচরো ব্যবসা, শিক্ষা এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। আইএজি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন গ্রুপ, শিক্ষা সংস্থা জিইডিইউয়ের মতো প্রথম সারির ব্রিটিশ বাণিজ্য সংস্থার প্রতিনিধিরা হাজির ছিলেন।
ব্রিটেনের শিল্পমহলের সামনে মমতা তুলে ধরেন বাংলায় মহিলাদের ক্ষমতায়ণের খতিয়ানও। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা মহিলা ক্ষমতায়ণে দেশে এক নম্বরে রয়েছি। অন্যেরা মুখে জনপ্রতিনিধিত্বে ৩৩ শতাংশ মহিলা সংরক্ষণের কথা বললেও আমার পার্টির ৩৯ শতাংশ নির্বাচিত সাংসদ মহিলা। আমি নিজে সাত বারের সাংসদ, তিন বারের বিধায়ক (পড়ুন মুখ্যমন্ত্রী)। ২০০৪ সালে বিরোধীদের যখন কেউ জিততে পারেনি, তখনও আমি জিতেছিলাম।’’ তাঁর কথায়, ‘‘বাংলার শ্রীবৃদ্ধি বহুমাত্রিক। আসুন আমরা একসঙ্গে জয় করি।’’
মমতা তাঁর বক্তৃতা শেষ করলেন তিন বার ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে। আশ্চর্য নয় যে, তখন হাততালির ঝড় বহিল সভাতে। তার পর, বাণিজ্য সম্মেলন শেষ করেই, মমতা নেমে পড়লেন লন্ডনের রাস্তায়। হাঁটতে।
- মঙ্গলবার বাণিজ্য সম্মেলন যোগ দেবেন মুখ্যমন্ত্রী। বুধবার হওয়ার কথা সরকারি স্তরে বাণিজ্য-বৈঠক।
- আগামী বৃহস্পতিবার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দেওয়ার কর্মসূচি রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর।
-
১৮:১৪
বাপু, সংবিধানটাকে রক্ষা কোরো! ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে। ডোনা, হাঁটো তো দেখি। একা একা হবে না, দলে এসো ভাই -
কলকাতায় ফুটবল স্কুল খুলছে ম্যান সিটি। লন্ডনে রবিঠাকুরের গানে মমতা। সোনার চেয়েও দামি এবং ঠান্ডায় নো পাকামি
-
লন্ডনের ভারতীয় দূতাবাসে আবির্ভূত ‘দিদি’ মমতা, তবে করে রাখলেন মঙ্গলবারের বাণিজ্যবৈঠকের নান্দীমুখটিও
-
সে বার মহারানির ডাকে প্রাসাদে, এ বার অক্সফোর্ডে সঙ্গী হচ্ছেন মহারাজ! রোদ ঝলমলে লন্ডনের পথে মমতার ‘ওয়ার্ম আপ’
-
বিমানে এল ‘শুভযাত্রা’ কেক, লন্ডনে বিক্ষোভ দেখা হল না মমতার, যেমন তাঁর সঙ্গে ছবি তোলা হল না প্রবাসীর