অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। —গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।
‘ইন্ডিয়া’র অন্দরে আসন সমঝোতার বল গড়াতে শুরু করেছে। লোকসভা ভোটে রাজ্যে ‘একের বিরুদ্ধে এক’ লড়াই চাইছেন বাংলার শাসকদল তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও তিনি জানেন, পশ্চিমবঙ্গে বিরোধীদের মধ্যে সার্বিক আসন সমঝোতা হওয়া সম্ভব নয়। জোট হতে পারে কংগ্রেস-তৃণমূলের। সেই সমঝোতা যাতে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত হয়ে যায়, সেই মর্মে নয়াদিল্লিতে ‘ইন্ডিয়া’র সাম্প্রতিক বৈঠকে বার্তা দিয়ে এসেছেন তৃণমূল নেত্রী। মমতার সঙ্গে আসন সমঝোতার আগে দলীয় স্তরে প্রাথমিক আলোচনা সারতে বুধবার রাতেই প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন এআইসিসি নেতৃত্ব।
দর কষাকষিতে কারা কতটা পাবে, তা নির্ভর করছে দুই শিবিরের নিয়ন্তাদের ‘নমনীয়তা’ এবং ‘সদিচ্ছা’র উপর। কিন্তু এটা নিশ্চিত যে, আসন সমঝোতা চূড়ান্ত হয়ে গেলে বাংলার শাসক শিবিরের অন্দরেও আলোড়ন উঠবে। আলোড়ন— কারা তৃণমূলের টিকিটে দাঁড়াবেন লোকসভা ভোটে, তা নিয়ে। সৌজন্যে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বয়সনীতি চালুর ভাবনা এবং প্রকাশ্যে তা আরও এক বার বলা। যা দলের নেতাদের মধ্যেই মতের বৈপরীত্য তৈরি করে দিয়েছে।
তবে এটা স্পষ্ট যে, অভিষেকের বয়সনীতি (অবসরের ঊর্ধ্বসীমা) নিয়ে দলের প্রবীণদের একটি অংশ যেমন অখুশি, তেমনই নতুন প্রজন্মের অনেকে উৎসাহী। ঘরোয়া আলোচনায় তাঁরা উৎফুল্লও বটে। কিন্তু অভিষেক দলের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে যা করতে চান, তা কতটা বাস্তবায়িত করতে পারবেন, কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে খানিক সংশয় রয়েছে তাঁর অনুগামী নেতাদের একাংশের মধ্যেই।
২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের পর অভিষেককে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পর থেকেই সাংগঠনিক সংস্কারের কাজ শুরু করার চেষ্টা করেছিলেন তৃণমূলের ‘সেনাপতি’। তাঁর প্রথম লক্ষ্য ছিল দলে ‘এক ব্যক্তি, এক পদ’ নীতি বাস্তবায়িত করা। অর্থাৎ, দলের কেউ সংগঠনে বড় পদে থাকলে তিনি সরকারে কোনও বড় পদে (যেমন মন্ত্রিসভা) থাকতে পারবেন না। আবার কেউ সরকারে বড় কোনও পদে থাকলে অন্য কোনও বড় সাংগঠনিক দায়িত্বে থাকতে পারবেন না। কারণ, তাতে দু’টি বিভাগই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু সেই নীতি পুরোপুরি বাস্তবায়িত করতে পারেননি অভিষেক। কিয়দংশে তিনি সফল হলেও বড় অংশের ক্ষেত্রে তাঁকে দলের অন্দরে বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। দলের মধ্যে সেই সময়েই চাপা দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল। ঘটনাচক্রে, যে সময়ে অভিষেক ওই নীতির কথা বলেছিলেন, তখন দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। পাশাপাশিই তিনি মন্ত্রিসভারও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। একই ভাবে ফিরহাদ হাকিম রাজ্যের মন্ত্রী এবং কলকাতার মেয়র। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক মন্ত্রী থাকার পাশাপাশি ছিলেন দলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সভাপতি। যে জেলার বিস্তৃতি সন্দেশখালি থেকে সল্টলেক পর্যন্ত। পার্থ বা ফিরহাদের ক্ষেত্রে এক ব্যক্তি এক পদ নীতি কার্যকর করা যায়নি। নিয়োগ দুর্নীতিতে পার্থ জেলে যাওয়ার পরে তৃণমূল তাঁকে সাসপেন্ড করে এবং তার পরে মন্ত্রিসভা ও দলের মহাসচিব পদ থেকে সরিয়ে দেয়। যদিও ফিরহাদ এখনও দু’টি পদই অলঙ্কৃত করে রয়েছেন। তবে উত্তর ২৪ পরগনাকে চারটি সাংগঠনিক জেলায় ভেঙে জ্যোতিপ্রিয়কে সাংগঠনিক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল গত বিধানসভা ভোটের পরেই। সম্প্রতি সেই বয়ঃসীমা নিয়ে নতুন করে জলঘোলা শুরু হয়েছে।
মাসখানেক আগে নেতাজি ইন্ডোরে তৃণমূলের বিশেষ অধিবেশনের মঞ্চ থেকে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ মন্তব্য করেছিলেন মমতা স্বয়ং। দমদমের প্রবীণ তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়ের নামোল্লেখ করে তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী বলেছিলেন, ‘‘বয়স আবার কী! মনের বয়সটাই আসল কথা।’’
তার পর থেকেই প্রকাশ্যে তৃণমূলের নেতাদের মধ্যে বয়স নিয়ে আকচাআকচি শুরু হয়ে যায়। দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ খোলাখুলিই বলেন, ‘‘কেউ যদি ভাবেন দেহত্যাগ না করলে পদত্যাগ করবেন না, তা হলে দলটা ক্রমশ সিপিএমের বৃদ্ধতন্ত্রের দিকে যাবে।’’ তবে পাশাপাশিই কুণাল এটাও স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই নীতিতে ফেলা যাবে না। কারণ তিনি সর্বময় নেত্রী, তিনি ব্যতিক্রম। কিন্তু কুণালের পাল্টা সৌগত মমতাকেই উদ্ধৃত করে বলেন, ‘‘মমতাই তো বলেছেন, বয়স বলে কিছু হয় না। মনের বয়সটাই আসল।’’
এই তাল ঠোকাঠুকি চলতে চলতেই অভিষেক বয়সনীতি নিয়ে আবার তাঁর অভিমতের কথা প্রকাশ্যে জানান। তিনি বলেন ‘‘আমি মনে করি, সব পেশার মতো রাজনীতিতেও একটা বয়ঃসীমা থাকা উচিত।’’ তাঁর কথায়, ‘‘নবীন-প্রবীণ সবাইকে নিয়েই দল চলবে। প্রবীণদের অভিজ্ঞতা দলের প্রয়োজন। তবে কাজের জন্য দরকার তরুণদের। যতই হোক, বয়স বাড়লে কাজের ক্ষমতা কিছুটা হলেও কমে।’’ উদাহরণ দিয়ে অভিষেক বলেছিলেন, ‘‘আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, সমস্ত পেশাতেই অবসরের বয়ঃসীমা আছে। বয়সের ঊর্ধ্বসীমাও আছে। শুধু রাজনীতি কেন? ক্রিকেট, ফুটবল, ডাক্তারি— সবেতেই অবসরের বয়স আছে।’’ তবে একইসঙ্গে তিনি এ-ও বলেছিলেন যে, ‘‘যদি কেউ মনে করেন, যাঁদের বয়স ২০, ২৫ বা ৩০— তাঁরাই শুধু তৃণমূল করবেন, তা হলে মনে রাখতে হবে, বিষয়টা তেমনও নয়।’’
অভিষেকের বক্তব্যকে আবার খারিজ করে দেন প্রবীণ সাংসদ তথা আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। শ্রীরামপুরের সাংসদ কল্যাণের সঙ্গে অভিষেকের সম্পর্ক অতীতে কেমন ছিল, তা সর্বজনবিদিত। তবে গত এক বছরে তাতে অনেকটা বদল দেখা গিয়েছিল। এতটাই যে, রাজভবনের অদূরে অভিষেকের ধর্নামঞ্চে ‘সেনাপতি’ সম্পর্কে কল্যাণের ‘স্তুতি’ অনেক তৃণমূল নেতাকেও বিস্মিত করেছিল। কিন্তু বয়সনীতি নিয়ে অভিষেকের অভিমত সম্পর্কে আদালতের চৌহদ্দিতে প্রবীণ আইনজীবীদের উদাহরণ দিয়ে কল্যাণ বলেন, ‘‘৯০ বছরের শক্তিনাথ মুখোপাধ্যায়ের কি কোর্টে প্রোডাক্টিভিটি কমেছে? অনিন্দ্য মিত্র ব্যারিস্টার। তাঁর বয়স ৮৭। প্রোডাক্টিভিটি কমেছে? বয়স ফ্যাক্টর নয়। মানুষের যোগ্যতাই হল ফ্যাক্টর।’’
তৃণমূলে এই বয়স বিতর্ক যখন আশা-আশঙ্কার দোলাচল তৈরি করছে, তখন ফিরহাদও বলেন, ‘‘মানুষের কাছে যাঁর গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, তাঁকে প্রার্থী করা উচিত। তিনি প্রবীণ হলে প্রবীণ হবেন, নবীন হলে নবীন হবেন। আমি এখনও বলছি, ডায়মন্ড হারবারে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য প্রার্থী হলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এমন অনেকেই আছেন, যাঁদের মানুষ গ্রহণ করেছে, তাঁরাই থাকবেন।’’ এর পরেই তাঁর মন্তব্য ছিল, ‘‘আমি নিজেকে মধ্যবয়স্ক বলি। আমি নিজে নবীন-প্রবীণের মাঝখানে রয়েছি।’’ ফিরহাদ আরও বলেছিলেন, ‘‘অবসরের বয়ঃসীমা চাকরির ক্ষেত্রে থাকতে পারে। কিন্তু আমরা তো চাকরি করি না। আমরা স্বেচ্ছাসেবক।’’
কয়েক বছর আগে দলে বয়সনীতি নির্ধারণ করেছে সিপিএম। দলের কেন্দ্রীয় কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েই তা করেছিল। যেমন, ৭০ বছরের বেশি বয়সি কেউ রাজ্য কমিটিতে থাকতে পারবেন না। ৭৫ বছর বয়স হয়ে গেলে বিদায় নিতে হবে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে। সেই নীতিতে সিপিএমের আগামী পার্টি কংগ্রেসে প্রকাশ কারাট, বৃন্দা কারাট, মানিক সরকার-সহ এক ঝাঁক নেতানেত্রীকে কেন্দ্রীয় কমিটির পদ ছেড়ে দিতে হবে। বাংলার ক্ষেত্রেও তা বাস্তবায়িত হয়েছে। তবে এ কথা ঠিক যে, সিপিএম বয়সজনিত নীতি গ্রহণ করেছে বাংলা ও ত্রিপুরার ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর। কিন্তু ক্ষমতার ভরা সময়ে অভিষেক তৃণমূলে তা কার্যকর করতে চাইছেন। তৃণমূলের অনেকের মতেই, অভিষেকের কাজটা তাই কঠিন। তা ছাড়া তিনি যে ভাবে একটা পেশাদার কাঠামোয় দলকে বাঁধতে চাইছেন, অনেক দূরের দিকে তাকিয়ে ভাবতে চাইছেন, তাতে তাঁকে বাধার মুখে পড়তে হবে। অনেকের মতে, ক্ষমতাসীন দলে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে গেলে বাধা আসবেই। কিন্তু অভিষেককে যাঁরা কাছ থেকে চেনেন, তাঁদের অনেকেই বলছেন, তৃণমূলের সেনাপতি আলটপকা কথা বলেন না। যা বলেন, ভেবেচিন্তেই বলেন। তার নেপথ্যে থাকে নিপুণ পরিকল্পনা।
অভিষেকের বয়সনীতি নিয়ে ইতিমধ্যেই মন্থন শুরু হয়েছে তৃণমূলের অন্দরে। তা থেকে অমৃত উঠবে না গরল, তা ভবিষ্যৎ বলবে। কিন্তু তিনি যদি তৃণমূলে বয়সনীতি অনতিবিলম্বে কার্যকর করতে পারেন, তা হলে কেমন হবে বাংলার শাসকদলের ছবি? (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy