রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর সামলান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু স্বাস্থ্যই নয়, রাজ্য সরকারের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দফতর মুখ্যমন্ত্রী নিজের হাতে রেখেছেন। কেন তিনি নিজেই স্বাস্থ্য দফতর সামলান, সোমবার চিকিৎসকদের সম্মেলনে তা নিজেই বোঝালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, স্বাস্থ্য দফতরের কাজের পরিসর অনেকটা বড়। পুরো বিষয়টির উপর নজর রাখতে হয়। এক জন ‘রাজ্যমন্ত্রী’র পক্ষে স্বাস্থ্য বিভাগের উন্নয়নের কাজ কখনও দেখাশোনা করা সম্ভব হয় না বলেই মনে করেন তিনি। সেই কারণেই রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর নিজের হাতেই রেখেছেন মমতা।
আলিপুরের ধনধান্য প্রেক্ষাগৃহে চিকিৎসকদের সম্মেলনে বক্তৃতা করছিলেন মমতা। বক্তৃতার শুরুর দিকেই নিজের হাতে স্বাস্থ্য দফতর রেখে দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেন তিনি। এই প্রসঙ্গে বাম জমানার সঙ্গে তাঁর আমলের স্বাস্থ্য দফতরের কাজের ফারাকও বোঝানোর চেষ্টা করেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর অভিযোগ, বাম জমানায় রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে অবহেলা করা হত। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে স্বাস্থ্য দফতরের প্রসঙ্গ টেনে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “এক জন রাজ্যমন্ত্রী স্বাস্থ্য দফতর চালাতেন। তাঁর কিছুই করার ছিল না। টিমটিমিয়ে কোনও রকমে চলত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা।” তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে কী কী পরিবর্তন এনেছে, তা-ও তুলে ধরেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, আগে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ছোট ছোট গেট ছিল। ফলে কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে তাড়াতাড়ি বার হওয়ার উপায় ছিল না। বর্তমান সরকারের আমলে হাসপাতালের গেটগুলি বড় করে দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালগুলিকে রং করা হয়েছে এবং সেখানে রোগীর পরিজনদের জন্য রাতের আশ্রয়স্থল (নাইট শেল্টার) তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি টেলিমেডিসিন পরিষেবা এবং ‘স্বাস্থ্যসাথী’ প্রকল্পে সরকারের সাফল্যের কথাও তুলে ধরেন মুখ্যমন্ত্রী।
চিকিৎসকদের সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী প্রায় ৩৮ মিনিট বক্তৃতা করেন। তাতে আরজিকর-কাণ্ডে দোষীর যোগ্য শাস্তির দাবি থেকে শুরু করে জুনিয়র ডাক্তারদের বেতন, মেদিনীপুর মেডিক্যালের স্যালাইন-কাণ্ড, সরকারি হাসপাতালে নিয়োগ সংক্রান্ত সমস্যা-সহ বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে।
মেয়াদ-উত্তীর্ণ ওষুধ, স্যালাইনে নজরদারি
মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে ‘রিঙ্গার্স ল্যাকটেট’ স্যালাইন ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। তা নিয়ে মামলাও হয়েছে আদালতে। চিকিৎসকদের সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী জানান, মেদিনীপুরের ঘটনায় গাফিলতি নিশ্চয়ই ছিল। সেটির তদন্ত হচ্ছে। তাই এ বিষয়ে এখনই কোনও মন্তব্য করতে চাননি মুখ্যমন্ত্রী। ওই ঘটনার সময়ে হাসপাতালের সিনিয়র ডাক্তারদের পাশাপাশি কয়েক জন জুনিয়র ডাক্তারকে নিলম্বিত (সাসপেন্ড) করা হয়েছিল। স্বাস্থ্য ভবন সাত জন জুনিয়র ডাক্তার-সহ ১৩ জন চিকিৎসককে সাসপেন্ড করেছিল। মুখ্যমন্ত্রী সোমবার জানান, ওই ঘটনায় জুনিয়র ডাক্তারদের নিলম্বিত করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর মতে, জুনিয়র ডাক্তারদের উপর দায়িত্ব ছেড়ে যাওয়া উচিত হয়নি সিনিয়রদের। মেয়াদ-উত্তীর্ণ ওষুধ বা স্যালাইন যাতে কোনও হাসপাতালে না-থাকে, সে জন্য তিন মাস অন্তর যাচাই করার নির্দেশ দেন মমতা।
আরও পড়ুন:
রাজনীতির ঊর্ধ্বে ওঠার বার্তা
দলমত নির্বিশেষে চিকিৎসকদের একত্রিত হয়ে কাজ করার বার্তা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, চিকিৎসকদের একটিই রং। তা হল মানবতার এবং সেবার। মমতা বলেন, “আমাদের সরকার রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে ডাক্তারদের সম্মান করে।” অনুরূপ ভাবে চিকিৎসকদেরও রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি। মমতার কথায়, “স্বাস্থ্যের আর এক নাম সেবা। মানুষ বিপদে পড়লে আপনাদের কাছেই ছুটে যান। হয়তো সব ক্ষেত্রে বাঁচানো সম্ভব নয়। কিন্তু যদি একটু ভাল ব্যবহার পান, যদি দেখেন অন্তত চিকিৎসকেরা চেষ্টা করেছেন, তাতেই তাঁরা খুশি হয়ে যান। রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে পরিবারের লোকেরা আশীর্বাদ করেন।” তিনি আরও বলেন, “চিকিৎসা মানে আমার কাছে সেবা, নিষ্ঠা, জ্ঞান, দক্ষতা, উদারতা, মানবতা, সংবেদনশীলতা, সমবেদনা এবং ধৈর্য। আমি মনে করি, চিকিৎসকদের কোনও রাজনৈতিক রং নেই। তাঁদের একটাই রং, মানবতার এবং সেবার।” করোনার সময়ে সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলি যে ভাবে রোগীদের পাশে দাঁড়িয়েছে, তারও প্রশংসা করেন মুখ্যমন্ত্রী। একই সঙ্গে রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন তথ্যেরও সমালোচনা করেন মমতা। তিনি বলেন, “হাজারটা ভাল কাজ করুন, তা বেরোবে না। কিন্তু একটি খারাপ কাজ হলে সেটি এমন ভাবে প্রচার করা হয়, যেন কোনও চিকিৎসক পরিষেবা দিচ্ছেন না। এটি ঠিক নয়।”
আরও পড়ুন:
ওবিসি শংসাপত্র মামলা আটকে চিকিৎসক নিয়োগ
রাজ্যের ওবিসি শংসাপত্র সংক্রান্ত একটি মামলা বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। ওই মামলার প্রসঙ্গও উঠে আসে ধনধান্য প্রেক্ষাগৃহে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতায়। তিনি জানান, ওই মামলার কারণে চিকিৎসক, নার্স, শিক্ষক-সহ বিভিন্ন সরকারি কাজে নিয়োগ থমকে রয়েছে। কলকাতার সরকারি হাসপাতালগুলিতে রোগী দেখার যে চাপ থাকে, তা নিয়ে সমাবেশে উপস্থিতি চিকিৎসকদের সামনে উল্লেখ করেন তিনি। সেই সময়েই উঠে আসে ওবিসি শংসাপত্র মামলার জন্য চিকিৎসক-নার্স নিয়োগ আটকে থাকার প্রসঙ্গ। এই পরিস্থিতিতে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া জেলা হাসপাতালগুলি থেকে যাতে রোগীদের কলকাতার হাসপাতালে না-পাঠানো হয়, সেই প্রস্তাবও দেন মুখ্যমন্ত্রী।
আরজি কর-কাণ্ডে দোষীর উপযুক্ত শাস্তির দাবি
আরজি করের মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের মামলায় সঞ্জয় রায়ের ফাঁসির জন্য সওয়াল করেছিল রাজ্য। তবে নিম্ন আদালতে দোষীর আমৃত্যু কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছে। চিকিৎসকদের সম্মেলনে বক্তৃতার সময়ে আরজি করে নির্যাতিতার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্য সরকার যে দোষীর উপযুক্ত শাস্তির পক্ষে, তা-ও মনে করিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতা মনে করিয়ে দেন, আরজি কর-কাণ্ডে দোষীর শাস্তির দাবিতে তিনি নিজেও রাস্তায় নেমেছিলেন। আরজি করে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পর রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলির নিরাপত্তা এবং পরিকাঠামো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। চিকিৎসক সমাজের একাংশের সঙ্গে দৃশ্যত কিছুটা দূরত্বও তৈরি হয় সরকারের। সোমবার চিকিৎসক সম্মেলন থেকে সেই দূরত্ব ঘোচানোর চেষ্টা করলেন মুখ্যমন্ত্রী।
আরও পড়ুন:
হাসপাতালে নিরাপত্তার প্রসঙ্গ
চিকিৎসকদের তরফে বেশ কিছু প্রস্তাব জমা পড়েছে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। সোমবার মমতা জানান, ওই প্রস্তাবগুলির মধ্যে সব মেনে নেওয়া সম্ভব না-হলেও যতটুকু সম্ভব তিনি করছেন। হাসপাতালে নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়েও কিছু প্রস্তাব পেয়েছেন তিনি। এ কথা বলেই তৎক্ষণাৎ মঞ্চে থাকা রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার এবং কলকাতার পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মাকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করার নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। আরও বেশি নজরদারি এবং প্রয়োজনে পুলিশের মোবাইল ভ্যান (নজরদারির গাড়ি) বৃদ্ধির কথাও বলেন তিনি। হাসপাতালের নিরাপত্তার জন্য নতুন নিয়োগ না-হওয়া পর্যন্ত অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদেরও ব্যবহার করার পরামর্শ দেন মমতা। পাশাপাশি উঠে আসে সিভিক ভলান্টিয়ারদের প্রশিক্ষণের প্রসঙ্গও। যে সিভিকদের কনস্টেবল পদে চাকরি দেওয়া হবে, তাঁদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী। যদিও তাঁদের হাসপাতালে নিরপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশদলের সঙ্গে কোনও দায়িত্বে রাখা হবে কি না, তা উল্লেখ করেননি মুখ্যমন্ত্রী।
স্বাস্থ্য পরিকাঠামোয় উন্নয়ন
হাসপাতালগুলির পরিকাঠামোগত উন্নয়নে সরকারের উদ্যোগের কথাও চিকিৎসকদের বোঝান মুখ্যমন্ত্রী। আরজি কর, এসএসকেএম এবং মেদিনীপুর কলেজে হস্টেল তৈরি করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। পাশাপাশি হাসপাতালে মহিলাদের শৌচালয়ে বা হস্টেলে কোনও সমস্যা রয়েছে কি না, সে দিকেও নজর রাখার জন্য অধ্যক্ষদের পরামর্শ দেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি জানান, এখন অনেকেই ছোটখাটো শারীরিক সমস্যার কারণে চিকিৎসক দেখাতে চান না। এই প্রবণতা সঠিক না-হলেও বর্তমানে এমন ঘটনা অনেক ক্ষেত্রেই ঘটে। রাজ্য সরকার সেই কারণে ‘স্বাস্থ্য ইঙ্গিত’ বা টেলিমেডিসিন পরিষেবা চালু করেছে। ইতিমধ্যে চার কোটি ৮২ লক্ষ মানুষকে টেলিমেডিসিন পরিষেবা দেওয়া হয়েছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে প্রতি দিন গড়ে ৭৫ হাজার রোগীকে সাহায্য করা হয়। ‘স্বাস্থ্যসাথী’ প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছেন রাজ্যের ন’কোটি মানুষ। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমাদের আমলে দেশের সেরা সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামো (পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার হেল্থ) এই রাজ্যে। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৩৮টি মেডিক্যাল কলেজ, ৪২টি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল করা হয়েছে। ১৩ হাজার ৫০০-র বেশি সুস্বাস্থ্য কেন্দ্র করেছি, কথা দিয়েছি আগামীতে আরও ১২ হাজার সুস্বাস্থ্য কেন্দ্র করা হবে।”