অরুণ সিংহ
নবজাতক চিকিৎসায় দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস (এইমস) বেছে নিল পশ্চিমবঙ্গ মডেলকে। আর এই কাজে তারা মুখ্য পরামর্শদাতা হিসেবে বেছে নিয়েছে এমন একজনকে যিনি পরিবর্তনের সরকারের চোখে ব্রাত্য। এইমস কর্তাদের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গে নবজাতক চিকিৎসার দিশা দেখিয়েছেন ওই চিকিৎসক, অরুণ সিংহ। যদিও পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁর কাজকে স্বীকৃতি না দেওয়ায় তিনি এই মুহূর্তে দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।
অরুণ সিংহের থেকে কী পরামর্শ নিতে চাইছে এইমসের নিওন্যাটাল চিকিৎসকরা? এইমস সূত্রের খবর, নবজাতক (নিওন্যাটোলজি) বিভাগটি সামগ্রিক ভাবে শিশু বিভাগের (পেডিয়াট্রিক) অধীনেই রয়েছে। এখন কলকাতার এসএসকেএমের ধাঁচে পৃথক নিওন্যাটোলজি বিভাগ গড়তে চায় এইমস। যেখানে আলাদা বিল্ডিং হবে। থাকবে হিউম্যান মিল্ক ব্যাঙ্ক, নবজাতকদের অস্ত্রোপচারের পৃথক ব্যবস্থা এবং তাদের দৃষ্টি-শ্রবণ ও বুদ্ধিবৃত্তি মাপা ও তার উন্নতির (নিউরো ডেভলপমেন্ট) ব্যবস্থা। নিউরো ডেভলপমেন্ট ব্যবস্থা অবশ্য আগে থেকেই এইমসে রয়েছে।
এইমসের চিকিৎসক অশোক দেওরাড়ি বলেছেন, ‘‘কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক এইমসে মাদার অ্যান্ড চাইল্ড কেয়ার সেন্টার করতে চাইছে। কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে।’’ ইতিমধ্যে পেডিয়াট্রিক বিভাগের প্রধান চিকিৎসক বিনোদকুমার পলের সঙ্গে অরুণবাবুর বৈঠক হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কর্তারাও জানিয়েছেন, তাঁরা চান এইমস-কে নিজের যাবতীয় অভিজ্ঞতা দিয়ে সহায়তা করুন অরুণ সিংহই। আর তাই এসএসকেএম হাসপাতাল পরিদর্শনে আসতে হতে পারে ওই চিকিৎসককে।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার অরুণবাবুকে সেই অনুমোদন দেবে না বলে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে। এইমস অরুণবাবুকে নবজাতক চিকিৎসায় স্বীকৃতি দিতে চাইলেও, পশ্চিমবঙ্গ সরকার কিন্তু তাঁর অবদান স্বীকার করতে রাজি নয়। তৃণমূল সরকারের আমলে স্বাস্থ্যকর্তাদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে রাজ্য-ছাড়া হয়েছিলেন তিনি। সেই বিবাদ যে এখনও মেটেনি তা রাজ্যের স্বাস্থ্য-কর্তাদের মন্তব্যেই স্পষ্ট।
রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে মা ও শিশু মৃত্যুর হার কমাতে একটি টাস্ক ফোর্স করা হয়েছিল। সেই ফোর্সের চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘একা অরুণ সিংহ সব কিছু করেছেন, এটা একটা ‘মিথ’। যা হয়েছে সকলে মিলে করা হয়েছে। তা ছাড়া এইমস এমনিতেই স্বয়ংসম্পূর্ণ। তার পরেও যদি ওই সংস্থার তরফে নবজাতক চিকিৎসা নিয়ে কিছু জানতে চাওয়া হয়, তা হলে ওরা সরাসরি এখানে এসে কথা বলুক। ওরা এ জন্য যদি অরুণ সিংহের পরামর্শ চায় তা হলে তার মতো হাস্যকর আর কী হতে পারে?’’
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রের খবর, নবজাতক চিকিৎসায় এসএসকেএম মডেল এখন অনুসরণ করছে দেশের ৫৪০টি জেলা। প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমারেও অনুসরণ করা হচ্ছে এই মডেল। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর স্বীকার করুক বা না করুক, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক কিন্তু মনে করে ওই মডেলের জনক অরুণ সিংহই। এইমস-এর পেডিয়াট্রিকস বিভাগের কর্তারা জানিয়েছেন, এসএসকেএমের নবজাতক বিভাগটি সম্পর্কে তাঁরা ভাল রকম ওয়াকিবহাল। দিল্লিতে তাঁরা নিজেদের প্রতিষ্ঠানে যে নবজাতক বিভাগটি গড়ে তুলতে চান, সেটি খানিকটা এসএসকেএমের আদলে হবে। সেই কারণেই অরুণ সিংহকে তাঁদের প্রয়োজন।
বস্তুত, এ রাজ্যে নবজাতক চিকিৎসায় দিশা দেখিয়েছিল এসএসকেএম। তারই পাশাপাশি রাজ্যে শিশুমৃত্যুর হার কমাতে পুরুলিয়া দেবেন মাহাতো হাসপাতালে নবজাতক চিকিত্সার যে কেন্দ্রটি গড়ে উঠেছিল, তা এখন বেশ কয়েকটি রাজ্য, এমনকী প্রতিবেশী একাধিক রাষ্ট্রেও একটি মডেল। জেলা স্তরে আধুনিক পরিকাঠামো গড়ে তুলে কী ভাবে রুগ্ণ ও কম ওজনের নবজাতককে বাঁচানো যায়, তার নজির তৈরি করেই ‘মডেল’ হয়েছিল কেন্দ্রটি। কিন্তু পরবর্তী ধাপে এসএসকেএমের কাজ নিয়েও সমালোচনা হয়েছে। ‘পুরুলিয়া মডেলে’র কাজও থমকে গিয়েছে। শয্যা বাড়েনি, একে একে কিছু যন্ত্র খারাপ হয়েছে। আসেনি নতুন, আধুনিক সরঞ্জাম। চাহিদামতো চিকিত্সক-নার্স দেওয়া হয়নি।
জেলায় জেলায় সিক নিউ বর্ন কেয়ার ইউনিট গড়ার কাজও শুরু হয়েছিল। সেই প্রকল্পেও অন্যতম অংশীদার ছিলেন অরুণবাবুই। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ত্রিদিববাবুর সঙ্গে মতবিরোধের জেরে এসএসকেএম থেকে সরানো হয় অরুণবাবুকে। তাঁকে পাঠানো হয় সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজে, যেখানে নবজাতক চিকিৎসার বিভাগটিই নেই। তাঁর বিরুদ্ধে রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলে নানা অভিযোগ এনেও শেষ পর্যন্ত প্রমাণের অভাবে তা ধামাচাপা পড়ে যায় বলে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর। আপাতত কেন্দ্রের রাষ্ট্রীয় বাল স্বাস্থ্য কার্যক্রমের উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন তিনি। বর্তমানে দিল্লি নিবাসী অরুণবাবুর সঙ্গে এসএসকেএমের কার্যত তেমন কোনও যোগাযোগই নেই।
মতবিরোধের বিষয়টি অস্বীকার করেননি ত্রিদিববাবুও। তাঁর বক্তব্য, অরুণ সিংহকে তাঁদের কোনও প্রয়োজন নেই। অযথাই তাঁর ভূমিকাকে ফুলিয়েফাঁপিয়ে বড় করে তোলা হচ্ছে বলে অভিযোগ করে ত্রিদিববাবু বলেন, ‘‘ওঁর সহায়তা ছাড়াই রাজ্যের নবজাতক চিকিৎসার আরও উন্নতি হচ্ছে। এসএসকেএমের নবজাতক বিভাগে ২৪টি শয্যা ছিল। আমরা সেটা বাড়িয়ে ১১০টি করেছি।’’
কী বলছেন অরুণ সিংহ? তাঁর কথায়, ‘‘নতুন করে বিতর্ক বাড়াতে চাই না। এসএসকেএম আমার স্বপ্নের প্রকল্প। তিল তিল করে আমরা অনেকে মিলে সেটা তৈরি করেছি। এইমস যখন সেই ধাঁচে কিছু করতে চাইছে, তখন সব রকম ভাবে সাহায্য করব। মন দিয়ে কাজ করতে চেয়ে বার বার যে বিতর্কে জড়াতে হচ্ছে, তাতে আমি ক্লান্ত।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy