বাঁকুড়া আদালতে প্রমথনাথ মান্না। পিছনে গাড়ি থেকে নামছেন প্রদীপ চন্দ্র। শনিবার।—নিজস্ব চিত্র।
বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির হাজার হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারির তদন্তে সারদার সীমা ছাড়িয়ে আরও এগোল সিবিআই।
শুধু সারদা সংস্থাতেই আটকে না থেকে সিবিআই শনিবার এমপিএস গ্রিনারি ও আকাশদীপ নামে পশ্চিমবঙ্গের দু’টি অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেছে। এ দিন বিধাননগর আদালতে সিবিআইয়ের পক্ষ থেকে ওই সংস্থা দু’টির ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও ডিরেক্টরদের বিরুদ্ধে প্রতারণা, বিশ্বাসভঙ্গ ও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের মামলা রুজু করা হয়। সারদা ছাড়া রাজ্যের অন্য কোনও অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে এই প্রথম সিবিআই তদন্ত শুরু করল। প্রসঙ্গত, এমপিএস সংস্থার এমডি প্রমথনাথ মান্না এবং আর এক ডিরেক্টরকে রাজ্য পুলিশ শুক্রবারই গ্রেফতার করেছে।
সিবিআই সূত্রের খবর, শুধু এমপিএস ও আকাশদীপ নয়, রাজ্যের আর এক অর্থলগ্নি সংস্থা রোজভ্যালির বিরুদ্ধেও তদন্ত শুরু করার লক্ষ্যে জাল গুটোচ্ছে তারা। রোজভ্যালি নিয়ে তদন্তে ইতিমধ্যেই কিছুটা এগিয়েছে আর এক কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। সিবিআই সূত্রের খবর, রোজভ্যালি নিয়ে তদন্তের নথিপত্র জোগাড় করার ব্যাপারে ইতিমধ্যেই ইডি-র তদন্তকারীদের সঙ্গে তাঁদের প্রাথমিক কথাবার্তা হয়েছে। রোজভ্যালির বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু করার ব্যাপারে আগামী সপ্তাহে দিল্লিতে তদন্তকারী সংস্থার সদর দফতরে বৈঠক হতে পারে বলে সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছে।
রোজভ্যালি নিয়ে তদন্তে নেমে ইডি ইতিমধ্যেই ওই সংস্থার প্রায় আড়াই হাজার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ‘সিল’ করে দিয়েছে। বৃহস্পতিবার সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে ইডি দফতরে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় রোজভ্যালির কর্ণধার গৌতম কুণ্ডু এবং সংস্থার আর এক কর্মীকে। দফতর থেকে বেরিয়ে গৌতমবাবু দাবি করেছিলেন, আসলে তাঁকে নয়, তাঁর সংস্থার হিসাবরক্ষক তরুণ পণ্ডাকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল এবং তিনি শুধু সঙ্গে এসেছিলেন। রোজভ্যালির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, যে সমস্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ইডি সিল করে দিয়েছে, সেগুলি থেকে প্রায় দশ হাজার কর্মীকে বেতন দেওয়া হয়। কাজেই সেগুলি খুলে না দিলে পুজোর আগে কর্মীরা বেতন পাবেন না। এ নিয়ে ইডি কর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে গৌতম কুণ্ডু যান বলে রোজভ্যালির পক্ষ থেকে জানানো হয়।
গত ৯ মে সারদা-সহ ৪৪টি বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তের রায় দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল, এই ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারির সঙ্গে সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের যোগাযোগটাও খতিয়ে দেখতে হবে। সারদা কেলেঙ্কারিতে ইতিমধ্যেই রাজ্যের শাসক দলের যোগসূত্রের ইঙ্গিত পেয়েছেন সিবিআই এবং ইডি-র তদন্তকারীরা। সিবিআই গ্রেফতার করেছে রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি তথা তৃণমূলের সহ-সভাপতি রজত মজুমদারকে। তা ছাড়া, তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সৃঞ্জয় বসু, রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রীর প্রাক্তন আপ্ত-সহায়ক
রেজাউল ওরফে বাপি করিমকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সিবিআইয়ের এক কর্তা জানান, সারদার সঙ্গে সঙ্গে এ বার বাকি অভিযুক্ত অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির সঙ্গেও প্রভাবশালীদের যোগাযোগ খতিয়ে দেখা হবে।
সারদা কেলেঙ্কারিতে যে ভাবে শাসক দলের শীর্ষ নেতাদের নাম বার বার উঠে আসছে, তাতে তদন্তে সাহায্যকারীদের নিরাপত্তা নিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেকে। ইতিমধ্যেই শাসক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সুদীপ্ত সেনের সম্পর্ক নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলেছেন সাসপেন্ড হওয়া তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষ, প্রাক্তন তৃণমূল নেতা আসিফ খান এবং সুদীপ্তর গাড়িচালক অরবিন্দ সিংহ চৌহান। তাঁদের নিরাপত্তা নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহকে চিঠি দিচ্ছে বিজেপি। এ দিন বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, “আসিফ অনেক তথ্য দিচ্ছেন। তাঁকে ধন্যবাদ। কিন্তু তথ্য দিচ্ছেন বলেই তাঁর বা সুদীপ্ত সেনের গাড়ির চালক অরবিন্দের প্রাণসংশয় হতে পারে। তেমন ঘটনা হলে সারদা কেলেঙ্কারির অনেক তথ্যপ্রমাণ হারিয়ে যাবে।”
পুলিশের একাংশ অবশ্য বলছেন, সারদা কেলেঙ্কারির অনেক তথ্যই সিবিআই তদন্তভার হাতে নেওয়ার আগেই লোপাট হয়ে গিয়েছে। সেই সূত্রেই এ দিন এমপিএস সংস্থার বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্ত শুরু হওয়াকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে ব্যাখ্যা করছেন তাঁরা। কেন?
ওই পুলিশ আধিকারিকদের ব্যাখ্যা, প্রমথবাবুর বিরুদ্ধে বাঁকুড়া থানায় চারটি অভিযোগ ছিল। কিন্তু রাজ্য পুলিশের খাতায় তিনি ফেরার ছিলেন। ফলে, তাঁকে প্রথমে গ্রেফতার করা হয়নি। অথচ, ফেরার হিসেবেই তিনি কলকাতায় শ্যামল সেন কমিশনে এসেছিলেন! শুক্রবারও তিনি এবং সংস্থার আর এক ডিরেক্টর প্রবীর চন্দ্র কমিশনের দফতরে আসেন। সেই সময়ে আমানতকারীদের আইনজীবী অরিন্দম দাস কমিশনকে জানান, পুলিশের খাতায় প্রমথ মান্নাকে ফেরার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর পরেই প্রমথ মান্না ও প্রবীর চন্দ্রকে আটক করা হয়।
তদন্তকারীদের একাংশের দাবি, সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে সুদীপ্তদের গ্রেফতার ও জেরা করে বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিল রাজ্য পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট)। পরে তদন্তে নেমে সিবিআই সে সবের অনেক কিছুই হাতে পায়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রমথবাবুকে রাজ্য পুলিশ প্রথম গ্রেফতার করায় সিবিআইয়ের হাতে তথ্যপ্রমাণ পৌঁছনোয় সমস্যা হতে পারে বলেও পুলিশের অন্দরেই অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সিবিআই সূত্রে জানানো হয়েছে, শীঘ্রই প্রমথ মান্না ও প্রবীর চন্দ্রকে হেফাজতে নেওয়ার জন্য আদালতে আবেদন জানানো হবে।
এ দিন অবশ্য বাঁকুড়া আদালতের নির্দেশে এমপিএসের দুই কর্তাকে নিজেদের হেফাজতে পেয়েছে রাজ্য পুলিশ। পুলিশ সূত্রের খবর, শুক্রবার হেয়ার স্ট্রিট থানায় প্রমথবাবুদের আটক করা হয়েছে, এই খবর পেয়েই বাঁকুড়া পুলিশের একটি দল কলকাতায় রওনা হয়। শনিবার সকালে তাঁদের বাঁকুড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়।
এ দিন বাঁকুড়া আদালতের ভারপ্রাপ্ত মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট তনুশ্রী দত্ত ওই দু’জনকে একটি মামলায় তিন দিন পুলিশ হেফাজত এবং অন্য একটি মামলায় ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার বলেন, “আগেই ওঁদের ধরতে বাড়ি এবং অফিসে তল্লাশি চালানো হয়েছিল। কিন্তু পাওয়া যায়নি। হেয়ার স্ট্রিট থানায় তাঁদের আটক হওয়ার খবর পেয়েই পুলিশ পাঠিয়ে গ্রেফতার করে আনা হয়েছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy