অভিযোগ বিস্তর। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
বয়স সবে ন’বছর। কিন্তু সেই সময়ের মধ্যেই রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু আর্থিক বেনিয়ম হয়েছে বলে দাবি করেছে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (ক্যাগ)। রাজ্যের প্রিন্সিপাল অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেলের তরফে চিঠিও পাঠানো হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়কে। ৯ সেপ্টেম্বর পাঠানো সেই চিঠিতে যে যে ‘অনিয়ম ও অস্বচ্ছতা’র অভিযোগ মিলেছে, তার জবাব চাওয়া হয়েছে। সময় দেওয়া হয়েছে চার সপ্তাহ অর্থাৎ, এক মাস। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় এখনও জবাব দেয়নি। উপাচার্য দীপককুমার রায় এবং রেজিস্ট্রার দুর্লভ সরকার চিঠির কথা স্বীকার করে জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরবর্তী এগ্জ়িকিউটিভ কাউন্সিলের বৈঠকের পরে চিঠির জবাব দেওয়া হবে।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছিল। সেই সময় থেকে, অর্থাৎ ২০১৫-’১৬ আর্থিক বছর থেকে ২০২২-’২৩ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচের অডিট করে ক্যাগ। গত ২২ এপ্রিল থেকে ২৪ মে পর্যন্ত চলে অডিট। এর পরে ‘ইনস্পেকশন রিপোর্ট’ তৈরি করে তা বিশ্ববিদ্যালয়কে পাঠানো হয়েছে গত ৯ সেপ্টেম্বর। রিপোর্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের হিসাবে অস্বচ্ছতার অভিযোগ যেমন রয়েছে, তেমনই অনেক ক্ষেত্রে নিয়ম ভেঙে বিভিন্ন সংস্থাকে কাজের বরাত দেওয়া হয়েছে বলেও দাবি করেছে ক্যাগ। কয়েক জন অধ্যাপকের পদোন্নতির ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হয়নি বলেও রিপোর্টে উল্লেখ করেছে ক্যাগ।
ওই সব অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে না চাইলেও রেজিস্ট্রার দুর্লভ বলেন, ‘‘বিস্তারিত বলতে পারবেন উপাচার্য। তবে আমরা ক্যাগকে চিঠির উত্তর পাঠাব এগ্জ়িকিউটিভ কাউন্সিলের বৈঠকের পরে। ওই বৈঠকের পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ করা হবে।’’ কবে হবে সেই বৈঠক? উপাচার্য দীপককুমার বলেন, ‘‘রাজ্য সরকার বা উচ্চশিক্ষা দফতরের অনুমোদন মিললেই বৈঠক হবে। তার পরেই চিঠির জবাব তৈরি হবে।’’ তবে যে সময়কালের হিসাব নিয়ে অভিযোগ, সেটা তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার আগেই বলে জানিয়েছেন উপাচার্য। দীপককুমার বলেন, ‘‘২০২৩ সালের ২২ অগস্ট আমি উপাচার্য হিসাবে যোগ দিয়েছি। আর অডিট হয়েছে ২০২৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত খরচের।’’ একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন যে যে দফতর, সংস্থা বা ব্যক্তিকে নিয়ে অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের ইতিমধ্যেই চিঠি পাঠানো হয়েছে।
ক্যাগের রিপোর্টের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, উপাচার্যের বাংলো এবং কর্মীদের আবাসন বানানোর ক্ষেত্রে নির্মাণকারী সংস্থাকে অতিরিক্ত ২৫.৮১ লাখ টাকা দেওয়ার কথা। নিয়ম ভেঙে ৫৫ লাখ টাকা অগ্রিম দেওয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে ক্যাগ। ওই কাজের বরাত প্রথমে রাজ্য সরকার অনুমোদিত সংস্থাকে দেওয়া হলেও পরে তা নিয়ম ভেঙে অন্য এক সংস্থাকে দেওয়া হয় বলে দাবি ক্যাগের। বলা হয়েছে, ওই সংস্থাকে কোনও আইনি ‘ওয়ার্ক অর্ডার’ দেওয়া হয়নি, বিশ্ববিদ্যালয় কোনও চুক্তিও করেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণের ‘প্রজেক্ট রিপোর্ট’ বানাতে ৩৭.৬৮ লাখ টাকা খরচ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে ক্যাগ। এ ছাড়াও, রাজ্য সরকারের টেন্ডার নীতি অমান্য করে কয়েকটি সংস্থাকে বারংবার বিভিন্ন কাজের বরাত দেওয়া হয়েছে। যে সব ক্ষেত্রে কোনও দরপত্রের বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়নি।
ন’বছরের বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের জন্য তিনটি মোটর গাড়ি কেনা হয়েছে। ক্যাগের দাবি, ৪৩.২৯ লাখ টাকার গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে কোনও টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়নি। যদিও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিয়ম অনুযায়ী একটি বিলে পাঁচ লাখ টাকার বেশি খরচ করতে হলে ই-টেন্ডার বাধ্যতামূলক। এ ছাড়াও দু’টি দৈনিক সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে দরপত্রের বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়। গাড়ির ক্ষেত্রে রাজ্যের নিয়ম জিইএম (গভর্নমেন্ট ই-মার্কেটপ্লেস) থেকেই কিনতে হবে। কিন্তু রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় কোনও নিয়ম মানেনি বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি গাড়ি কেনার অগ্রিম দিয়ে দেওয়া হয় উপাচার্যের অনুমোদন পাওয়ার আগেই। শুধু তা-ই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় এক কোটি টাকার বেশি তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রেও কোনও টেন্ডার ডাকেনি। রাজ্য সরকারের নিয়ম মেনে যদিও টেকনিক্যাল ও ফিন্যানশিয়াল— দু’রকমের দরপত্রই আহ্বান করার কথা।
ক্যাগের দাবি, দরপত্র না আহ্বান করে বিভিন্ন সংস্থাকে সরাসরি আড়াই কোটি টাকার কাজের বরাত দেওয়ায় কর বাবদ রাজ্য সরকারের ক্ষতি হয়েছে সাত লাখের বেশি টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিন বানানোর ক্ষেত্রেও ২২ লাখ টাকার খরচকে ‘সন্দেহজনক’ বলেছে ক্যাগ। সিসিটিভি ব্যবস্থা, গ্রন্থাগার, স্মার্ট ক্লাসরুম বানানো কিংবা সল্টলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ভাড়া নেওয়া তিন কামরার ফ্ল্যাট-সহ অনেক কিছু নিয়ে ‘অস্বচ্ছতা’র অভিযোগ রয়েছে ক্যাগের রিপোর্টে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নীতি-নিয়মের তোয়াক্কা করা হয়নি বলে দাবি। এমন নানা তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি ক্যাগের দাবি, ২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ৯৭ লাখ টাকার চেয়ার-টেবিল কেনে। যা দোকান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আনতে খরচ হয়েছিল ৫.৪৮ লাখ টাকা। এ ছাড়াও বিভিন্ন বিভাগের এমন বহু লাখ টাকার খরচ দেখানো হয়েছে, যার যথাযথ রসিদ নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে।
এ সবের বাইরে ক্যাগের অভিযোগ, রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ জন অধ্যাপকের পদোন্নতির ক্ষেত্রে রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দফতরের নিয়ম মানা হয়নি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আচার্যের পাঠানো প্রতিনিধি ছাড়াই পদোন্নতির কমিটি তৈরি হয়। ওই এক ডজন অধ্যাপকদের মধ্যে অর্থনীতি বিভাগের সুব্রত সাহা রয়েছেন। যিনি শাসকদল তৃণমূলের অধ্যাপক সংগঠন ওয়েবকুপার উত্তর দিনাজপুর জেলার নেতা। অভিযোগের তালিকায় তাঁর নাম প্রসঙ্গে সুব্রত বলেন, ‘‘ওই রিপোর্ট আমি দেখিনি বলে কিছু বলতে পারব না। তবে আমার মনে হয়, কমিটি গঠনে বিশ্ববিদ্যালয় কোনও নিয়ম ভাঙেনি। তবে বিস্তারিত বলতে পারবেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং এগ্জিকিউটিভ কাউন্সিল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy