এই গেট দিয়েই কারখানায় ঢোকে কাঁচামালবোঝাই ওয়াগন। সেই দৃশ্য আর ক’দিন দেখা যাবে, তা নিয়ে সংশয়ে শ্রমিকেরা। বার্ন স্ট্যান্ডার্ডের বার্নপুর কারখানায় রবিবার। ছবি: শৈলেন সরকার
ছুটির দিনেও শোনা যাচ্ছে, যন্ত্রের ঘড়ঘড় শব্দ। কাজ হচ্ছে? প্রশ্ন করতেই মুখ থমথমে শ্রমিকদের। কোনও রকমে বললেন, ‘আর ক’দিন!’
‘আর ক’দিন’, এই প্রশ্নই রবিবার দিনভর ঘুরপাক খাচ্ছে বার্ন স্ট্যান্ডার্ডের কর্মীদের মধ্যে। কারণ, রেল মন্ত্রক কারখানা কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছে, তালা ঝুলবে ওয়াগন নির্মাণ সংস্থা বার্ন স্ট্যান্ডার্ডে। রবিবার সকালে গিয়ে দেখা গেল, কারখানা চত্বর, কর্মী-আবাসন, সবখানেই একই আলোচনা। কারখানাটা তা হলে সত্যিই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে! সঙ্গে অবশ্য অন্য আশঙ্কাও রয়েছে। পাওনাগণ্ডার কী হবে। কারখানার শ্রমিক দিলীপ যাদবের প্রশ্ন, ‘‘কবে টাকাপয়সা পাব? পরিবার নিয়ে কোথায় দাঁড়াব!’’ পাশ থেকে সাধন হাজরা নামে অন্য এক শ্রমিক বললেন, ‘‘দু’বছর চাকরি বাকি। স্বেচ্ছাবসরের পুরো সুবিধাও পাব না।’’
তবে শুধু আক্ষেপ, আশঙ্কা নয়। রয়েছে ক্ষোভও। শ্যামল সাধু নামে এক শ্রমিকের যেমন প্রশ্ন, ‘‘কারখানা বন্ধ কেন হবে? চলতি আর্থিক বছরেই লাভ করেছি আমরা।’’ শ্রমিকেরা জানান, এখানে ফি দিনই ওয়াগনে কাঁচামাল আসছে। রেলের বরাতও পেয়েছে এই কারখানা। তার জন্য ৭৫টির মতো ওয়াগন তৈরি হয়েছে। আরও কয়েকটি তৈরির কাজ চলছে।
এই মুহূর্তে ২৫০জন কর্মী, ১৫০জন চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক কাজ করেন এখানে। তাঁদের সকলেরই ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছে শ্রমিক সংগঠনগুলি। সংস্থার পাঁচটি অনুমোদিত শ্রমিক সংগঠন যৌথভাবে ‘সেভ কমিটি’ তৈরি হয়েছিল। ওই কমিটির আহ্বায়ক বিএমএস নেতা অনিল সিংহ বলেন, ‘‘এর প্রতিবাদে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যাব।’’ তবে ভারতীয় হিন্দ মজদুর সভার নেতা দিলবাগ সিংহ, সিটু নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমার এখনই কারখানা বন্ধ হচ্ছে বলে বিশ্বাস করি না। ‘ন্যাশনাল কোম্পানি ল ট্রাইব্যুনাল’-এ আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি বার্ন স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে চূড়ান্ত শুনানি রয়েছে। ওই দিনের রায় দেখে সম্মিলিত ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’’
তবে বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের ভূমিকা নিয়েও চাপানউতোর শুরু হয়েছে জেলায়। সিটু নেতা বংশগোপাল চৌধুরী যেমন বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের যৌথ উদ্যোগে ফের কারখানা বন্ধ হচ্ছে।’’ যদিও রাজ্যের আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কারখানা খোলা রাখতে একাধিক চিঠি দিয়েছেন কেন্দ্রীয় সরকারকে। কিন্তু দিল্লি এই রাজ্যে কিছু চলতে দেবে না।’’ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়ের ভূমিকা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। যদিও বাবুল এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাননি। তবে আইএনটিটিইউসি-র রাজ্য সভাপতি তথা রাজ্যসভার সাংসদ দোলা সেন বলেন, ‘‘সংসদের ভিতরে ও বাইরে এবং আইনি লড়াই চালাব।’’
যে পথে বার্ন স্ট্যান্ডার্ড
• ১৯১৮: শুরুতে নাম, ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড ওয়াগন
• ১৯৭৫: সংস্থার জাতীয়করণ
• ১৯৭৬: বার্ন অ্যান্ড কোম্পানির সঙ্গে সংযুক্তি। নাম হল, বার্ন স্ট্যান্ডার্ড
• ১৯৮৭: বিবিইউএনএল-র অন্তর্গত হল কারখানা
• ১৯৯৪: রুগ্ণ ঘোষণা করে বিআইএফআর-এ পাঠানো হল সংস্থাকে
• ২০০০: কারখানা বাঁচাতে পুনরুজ্জীবন প্রকল্প কেন্দ্রীয় ভারী শিল্প মন্ত্রকে জমা দেন কর্তৃপক্ষ
• ২০০৯: তৎকালীন রেলমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব কারখানাটিকে রেলের অধিগৃহীত সংস্থা করার প্রস্তাব দিলেও, তা হয়নি
• ২০১০: তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় সংস্থাটিকে রেলের অধিগ্রহণের প্রস্তাব দেন। সেপ্টেম্বরে অধিগৃহীত হয়
• ২০১৭: সংস্থাটিকে দেউলিয়া ঘোষণার জন্য ‘ন্যাশনাল কোম্পানি ল’ট্রাইব্যুনালে’ পাঠানো হয়
• ২০১৮: রেল মন্ত্রক সংস্থা গোটানোর কথা জানাল
তবে রাজনৈতিক চাপানউতোর যাইই হোক না কেন, শ্রমিক পরিবারগুলিও ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। রেবা চক্রবর্তী নামে এক জন যেমন বললেন, ‘‘স্বামীর মাত্র তিন মাস চাকরি ছিল আর। অবসরের টাকাগুলো উনি তাড়াতাড়ি পাবেন তো?’’ শুধু শ্রমিক বা শ্রমিক পরিবার নয়, এলাকার অর্থনীতিতেও এই সিদ্ধান্তের প্রতিফলন দেখা যেতে শুরু করেছে। কারখানার গেটের সামনে প্রায় চার দশক ধরে চা-তেলেভাজার দোকান রয়েছে নিমাই গড়াইয়ের। সংসার চালাবেন কী ভাবে, সেই প্রশ্ন উস্কে দিলেন তিনিও। প্রভাব পড়েছে এলাকার প্রতি দিনের জীবনেও। রবিবার কর্মী আবাসন এলাকায় একটি ক্লাবের মুক্তমঞ্চে চলে ঘরোয়া খেলাধুলো। এ দিনও চলছিল। কিন্তু বেলা গড়াতেই সে জায়গাও প্রায় ফাঁকা। আসানসোল চেম্বার অফ কমার্সের উপদেষ্টা সুব্রত দত্তও বলেন, ‘‘বার্নস্ট্যান্ডার্ড বন্ধ হয়ে গেলে এই শিল্পের অর্থনীতির উপরে আঘাত আসবে। পরোক্ষে বানিজ্যের ক্ষতি হবে’’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy