পৌনে দু’শো বছরের ব্রিটিশ ঐতিহ্য অনেক দিনই ধরেই কোমায় চলে গিয়েছিল। দেড় দশক আগের অগ্নিকাণ্ডের পর সে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। অতঃপর প্রযুক্তির দিনবদল, সহজলভ্য ডিজিটাল ও মোবাইল ক্যামেরার দাপট। ফল যা হওয়ার, তা-ই হয়েছে। এশিয়ার দ্বিতীয় প্রাচীনতম স্টুডিও ‘বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড’ মৃত্যুই স্বীকার করে নিল।
কিন্তু এই শহরে ‘বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড’ মানে তো শুধু স্টুডিও নয়, আরও অনেক কিছু। ‘‘পুরনো স্ট্র্যান্ড রোড, হাওড়ার পন্টুন ব্রিজ মিলিয়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে পুরনো কলকাতার প্রায় ১২৬টা ফটোগ্রাফ আছে। কয়েকটা জনস্টন অ্যান্ড হফম্যান কোম্পানির, বাকি বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ডের,’’ বলছিলেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ও জাদুঘরের অধিকর্তা, ইতিহাসবিদ জয়ন্ত সেনগুপ্ত।
বাঙালির ইতিহাসে বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড মানেই সাদা-কালো পোর্ট্রেট ছবি। দামি কেমিক্যাল, দামি কাগজে প্রিন্ট করা ছবিতে হলুদ বিবর্ণতার ছোপ ধরত না। আর সেই পোর্ট্রেট রয়ে গিয়েছে ইতিহাসের সর্বস্তরে। ঢাকার আদালতে ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলা, ম্যাজিস্ট্রেট সমন জারি করে কলকাতা থেকে আনালেন ফটোগ্রাফার জন লরেন্স উইন্টারটনকে। বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ডের ফটোগ্রাফার উইন্টারটন তত দিনে কলকাতায় নিজের স্টুডিও খুলেছেন— ‘এডনা লরেঞ্জ’। ম্যাজিস্ট্রেট জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কয়েক বছর আগে তোলা এই ছবিটা আপনার? ছবির লোকটা আর এই সন্ন্যাসী এক?’’ উইন্টারটনের উত্তর: ‘‘হ্যাঁ।’’ বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড মানেই ইতিহাসের সাক্ষ্য।
শহরের অন্য পুরনো বনেদি দোকানগুলো বেঁচে থাকার তাগিদে রঙিন ছবি তুলতে শুরু করেছিল, কর্পোরেট থেকে বিয়েবাড়ি, সর্বত্র নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ‘বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড’ থেকে গিয়েছিল ‘জলসাঘর’-এর ছবি বিশ্বাসের মতোই। পোলারয়েড ক্যামেরা, ডিজিটাল প্রিন্ট তো দূর অস্ত্, রঙিন ছবি প্রিন্টের মেশিনটাও সে বসায়নি। মোবাইল ক্যামেরা আর ইনস্টাগ্রামের যুগে ‘বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড’-এর বাড়ি আর সাইনবোর্ডটাই নমো নমো করে টিকেছিল। এ বার তারও বিদায়।
এক কালে স্টুডিওর ছবি ছিল মঞ্চ বা সিনেমায় অভিনয়ের মতোই পারফরম্যান্স আর্ট। অনেক ক্ষণ ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে থাকত হতো, সঙ্গে ফুলদানি বা হাতলওয়ালা ডেক চেয়ারের মতো হরেক প্রপস। ক্রমে সহজলভ্য ক্যামেরা, দ্রুত গতির জীবন স্টুডিও ফটোগ্রাফির মৃত্যু ঘটিয়ে দেয়। বাজারে একের পর এক নিকন, জাইকা, আসাই পেন্ট্যাক্স। আর ডিজিটাল ক্যামেরা আসার পর তো কথাই নেই।
শহরের বনেদি স্টুডিও-ব্যবসায় তাই মৃত্যুই যেন নিয়তি। পার্ক স্ট্রিটের ‘বোম্বে ফোটো স্টুডিও’ অনেক দিনই ঝাঁপ গুটিয়েছে। ১৯০৯ সালে ভবানীপুরে তৈরি হয়েছিল ‘দাস স্টুডিও’। তার কর্ণধার সুপ্রিয় দাস জানাচ্ছেন, তাঁদের স্টুডিওর বাড়ি অর্ধেকের বেশি ভাঙা পড়েছে। কর্পোরেশন থেকে ‘বিপজ্জনক বাড়ি’ হিসেবে নোটিস পাওয়ার পর আর কিছু করার ছিল না।
জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলিতে, ১৯২১ সালে কর্নওয়ালিস রোডে শুরু হয়েছিল আর এক স্টুডিও ‘ডি রতন’। রবীন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্র ও জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনের অনেক পুরনো ছবি এঁদের কাছে আছে। দোকানের কর্ণধার রাজকুমার দে জানালেন, তাঁর অশীতিপর বাবা এখন বাড়িতে বসে মাঝে মাঝে ওই সব অ্যালবামের পাতা ওল্টান। ‘‘ডিজিটাল আর মোবাইল আসার পর সারা দেশেই ছবি তোলার ব্যবসা ধুঁকছে,’’ বলছিলেন তিনি। যে ‘ডি রতন’ একদা ব্রিটিশ আমলে মোহনবাগানের খেলা, তৎকালীন সিএবি ম্যাচের ছবি তুলত— এখন বিয়ের ছবি, কর্পোরেট ছবি তুলে তাদের বেঁচে থাকতে হয়।
স্যামুয়েল বোর্নের নামাঙ্কিত স্টুডিওটিও অন্য ভাবে বাঁচার চেষ্টা করেছিল, সফল হয়নি। বাড়ির বাইরে দু’টো ক্যামেরার দোকান, দু’টোই বন্ধ। ভিতরে লিফ্ট-এর পোড়া কঙ্কাল। ১৯৯১ সালের অগ্নিকাণ্ডের পর আর সারানো হয়নি। সঙ্গে বাড়িওয়ালা-ভাড়াটে বিবাদ।
দু’টো তলা মিলিয়ে সাড়ে চার হাজার বর্গফুটের জন্য মাত্র ৯০০ টাকা ভাড়া দিত স্টুডিও। অতঃপর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মাস দেড়েক আগে তারা বাড়ির মালিক লাইফ ইনসিওরেন্স কর্পোরেশনকে চাবি হস্তান্তর করে। ‘‘স্টুডিওয় কেউ আসতও না, লোকসানে চলছিল। আমরা এলআইসিকে চাবি হ্যান্ডওভার করে দিয়েছি,’’ জানালেন প্রেমশঙ্কর গুপ্ত। তিনিই দোকানের ম্যানেজার ছিলেন। স্টুডিও উঠে যাওয়ার পর এখন নাগপুরে দেশের বাড়িতে চলে গিয়েছেন।
কম্পিউটার আসার পর পাড়ায় পাড়ায় সব টাইপ-শর্টহ্যান্ডের স্কুল যে ভাবে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছে, বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড থেকে দাস স্টুডিও, সকলেই এখন সেই ভবিতব্যের দিকে তাকিয়ে। এ দেশে ফটোগ্রাফি দেখে যিনি বাঙালি ভদ্রমহিলার সামাজিক ইতিহাস লিখেছেন, সেই মালবিকা কার্লেকার বছর বারো আগে ‘বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড’-এ এসেছিলেন। ‘‘তখনই ওঁরা বলেছিলেন, আগুনে গোটা আর্কাইভ ছাই হয়ে গিয়েছে। এ বার ডিজিটালাইজেশনের দিকে যাবেন। স্টুডিওটির মৃত্যু দুঃখজনক, কিন্তু হতবাক হইনি।’’
স্টুডিও থাকে না, কিন্তু তার আত্মা রয়ে যায় ক্যাটালগে, আর্কাইভের ছবিতে। তাই পোড়া লিফ্টওয়ালা বাড়িতে নয়, স্যামুয়েল বোর্নের আত্মা রয়ে যাবে ভ্রমণপিপাসু বাঙালির রক্তে। আজ যে বাঙালি কাশ্মীর, শিমলা, কুলু-মানালি বেড়াতে গিয়ে মোবাইলে ছবি তুলে ইউ টিউবে পোস্ট করে, ওটিই বোর্ন সাহেবের ঐতিহ্য। ১৮৬৩ সালে শিমলা থেকে ৩০ জন কুলিকে নিয়ে বেরিয়েছিলেন, শতদ্রু, কিন্নর এলাকার ১৪৭টি নেগেটিভ নিয়ে ফিরে আসেন। পরের বার ছ’মাস ধরে কাশ্মীর, গঙ্গোত্রী, ধরমশালা ইত্যাদি। বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড সেই স্টুডিও, যার পোর্ট্রেট ছবিতে রয়ে গিয়েছে উনিশ ও বিশ শতকের নাগরিক জীবন। আর আউটডোর ছবিতে ভারতীয় ইতিহাস।
ইতিহাস রয়ে গেল কেমব্রিজ, ডিউক বিশ্ববিদ্যালয় ও স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটের আর্কাইভে। সেখানেই রয়েছে বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ডের বেশ কিছু ক্যাটালগ। তৎকালীন ভাইসরয়, মোগল বাদশা, লেফটেন্যান্ট গভর্নরদের প্রতিকৃতি। ক্যাটালগের ‘নেটিভ ক্যারেক্টার’ বিভাগে অ্যাক্রোব্যাট, সাপুড়ে প্রভৃতি। শ্রীরামকৃষ্ণ থেকে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী অনেকেই ছবি তুলেছিলেন সেই স্টুডিওতে, কিন্তু ক্যাটালগে উল্লেখ নেই। বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড মানে সাম্রাজ্যের নীল রক্তের জয়ধ্বজা। সত্যজিৎ রায় তাঁর নানা ছবির কাজে বারবার ফিরে গিয়েছেন সেই স্টুডিওর কাছে।
সেই নীল রক্তও নেই, সাম্রাজ্যও নেই। অমিত চৌধুরী বলছিলেন, ‘বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড ঐতিহ্য অবশ্যই। কিন্তু বাড়িটা আরও বড় ঐতিহ্য। ‘‘কলকাতা এখনও তার পরিসরগুলি সৃজনশীল ব্যবহার করতে পারে না।’’ স্টুডিও চলে গেলেও বাড়িটা বাঁচবে কি, চিন্তায় তিনি। গ্রিক কবি সেফেরিস সাধে লেখেননি, ‘স্ট্যাচুজ আর নট দ্য রুইনস, উই আর দ্য রুইনস।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy