চার খণ্ড আগে বেরিয়েছে। বাকি ১২ খণ্ডের মধ্যে আরও তিনটি প্রকাশের পরিকল্পনা ছিল এই বইমেলায়। যাবতীয় নজরুল-গীতির স্বরলিপি তৈরির ধকলের কাজটায় হাত দিয়েছিলেন মনির বিন আব্দুল আজিজ। যা পরিস্থিতি, এক খণ্ডের বেশি এখন প্রকাশের সাহস পাচ্ছেন না তিনি।
অমর্ত্য সেনের ‘নীতিশাস্ত্র ও অর্থনীতি’-বিষয়ক লেখা বাংলায় ছাপতে গিয়েও ঘোর অনর্থ। প্রকাশক দেবাশিস সাউয়ের কাছে এটাই বইমেলার টেক্কা। সাহস করে ১০০০ কপি ছাপতেও তিনি কিন্তু-কিন্তু করছেন।
অফসেটে ছাপা হলে এক সঙ্গে মোটামুটি ৫০০ কপি না-ছাপালে ক্ষতি। তবু ছোট প্রকাশকেরা অনেকেই বেশি বই ছাপানোর সাহস করছেন না। তাঁদের মতে, বই ছাপানোর ইউনিট পিছু খরচ হয়তো বাড়বে। তবু কম বই ছাপালে বাড়তি কাগজ কেনা বা বাঁধাইয়ের খরচ সামলানোর ঝক্কি থেকে অন্তত খানিকটা রেহাই মিলবে।
ছোট প্রকাশকেরা অনেকেই নিজেদের মেলে ধরতে কলকাতা বইমেলার দিকেই তাকিয়ে থাকেন। এই বচ্ছরকার পার্বণের কথা ভেবেই বইয়ের প্রচার, বিপণনের যাবতীয় ছক কষে এগোন তাঁরা। নোট-কাণ্ডের আচমকা ধাক্কায় ব্যস্ত সময়ে হঠাৎ সব ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে শুরু হবে বইমেলা।
কেন এই দশা?
প্রকাশকদের হা-হুতাশ, নোট-নাকাল দেশে পাঠকের দেখা কই? খোদ কলেজ স্ট্রিটেই বই বিক্রির হার যা মুখ থুবড়ে পড়েছে, তাতে বইমেলার পুঁজিটা আসবে কোথা থেকে? ব্যাঙ্কে টাকা থাকলেও তোলার জো নেই। অথচ, বইয়ের ভাঁজে কাপড়ের পট্টি থেকে বাঁধাইয়ের
নানা খরচ— প্রোডাকশনের ধাপে ধাপে কাজ মেটাতে নগদ ছাড়া কারও গতি নেই।
এই পরিস্থিতিতে অনেক বইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়েই প্রশ্নচিহ্ন। বাঙালি জীবনে দেশভাগের ক্ষত ও তার অভিঘাত নিয়ে বৈচিত্র্যময় সংকলন ‘বর্ডার’ সম্পাদনা করেছেন অধীর বিশ্বাস। দামি কাপড়ে মুড়ে সযত্নে বের করার ইচ্ছে। ‘‘ভেবেছিলাম অন্তত ১০০০ কপি ছাপব। এখন ৩০০-র বেশি সাহস হচ্ছে না।’’— বলছেন তিনি। কাজি হাসিনেরও আশঙ্কা, উনিশ শতকে বাংলার মুসলিম সমাজে পাশ্চাত্য চিকিৎসা চর্চা নিয়ে সাধের বইটারই বা কী হবে?
নোটের চোটে বিয়েবাড়ির মেনুতে ভেটকি ছেড়ে চিকেন করার মতোই বাজেট কাটছাঁটের মেজাজ এখানেও। কারিগর, হরফ, গাংচিল বা বিশ্ববঙ্গীয় প্রকাশনের মতো বই নির্মাতারা কার্যত অন্য রাস্তা দেখছেন না।
গুরুচণ্ডালী-র ঈপ্সিতা পাল বলছিলেন, ব্যাঙ্কে লাইন দেব, না বইমেলার কাজ করব? এ বইমেলায় আত্মপ্রকাশের অপেক্ষায় থাকা নয়া প্রকাশক ‘লিরিকাল’-এর সুমেরু মুখোপাধ্যায় তড়িঘড়ি কাঠখড় পুইয়ে ব্যাঙ্ক থেকে কার্ডে কেনাকাটার যন্ত্র বন্দোবস্ত করেছেন। বুকসেলার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স গিল্ড-এর সাধারণ সম্পাদক তথা পত্রভারতী-র কর্ণধার ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় বইমেলায় ঢালাও ‘প্লাস্টিক মানি’ লেনদেনের পরিকাঠামো রাখার আশ্বাস দিচ্ছেন। কিন্তু তাতেও বহু বাংলা বইয়ের প্রকাশক ধাক্কা খাবেন বলে তাঁর আশঙ্কা।
গত বার কম করে ২৫ কোটির কারবার দেখেছিল গিল্ড-এর বইমেলা। এ বার সেটা কত দূর সম্ভব হবে তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। এ সব মাথায় রেখেই পরিকল্পনা করছেন বড় প্রকাশকেরাও। ত্রিদিববাবুই বলছেন, ‘‘বইমেলায় ৫০টার বেশি বই করার ইচ্ছে ছিল। বড়জোর ১২-১৪টায় হাত দেব।’’ মিত্র ঘোষের ডিরেক্টর ইন্দ্রাণী রায়ের পর্যবেক্ষণ, ‘‘গোড়ার ধাক্কাটা সামান্য ফিকে হয়েছে। তবু নতুন বইয়ের সংখ্যা কমাতে হবে বলেই মনে হচ্ছে।’’
দে’জ প্রকাশনীর কর্ণধার শুভঙ্কর দে-র কাছে এই দুর্বিপাকে ভরসা বলতে প্রফুল্ল রায়, শঙ্কর, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ, সমরেশ মজুমদারের মতো জনপ্রিয় লেখকেরা। ‘‘এই নামী লেখকদের বই গত বছর ১১০০ কপি ছাপা হলেও এ বার ৫৫০ কপির বেশি ছাপার সাহস পাচ্ছি না।’’— বলছেন শুভঙ্কর।
আনন্দ পাবলিশার্স-এ অবশ্য সত্যজিৎ-শরদিন্দু-সুনীলের চিরকালীন বেস্ট সেলার বই বরাবরই কার্ডে বিক্রি হয়। তবে বইয়ের বাজার নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা কেউই অস্বীকার করছেন না। আনন্দ-এর তরফে সুবীর মিত্র বলছেন, ‘‘বইমেলার আগে এখনও হাতে কিছুটা সময়। এ মাসটায় বইয়ের বাজার কেমন যায়, দেখেই বাজেট নিয়ে আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy