পঞ্চায়েত ভোটের আগে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় উঠছে বিবিধ সন্ত্রাসের অভিযোগ। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সন্ধ্যা নামলেই এখনও সুনসান মুর্শিদাবাদের নওদার শিবনগর। এখনও স্থানীয় বাসিন্দাদের চোখেমুখে আতঙ্ক। তাঁরা এখনও মনে মনে বাস করেন নভেম্বরের সেই দিনটিতে। স্থানীয় ব্যবসায়ী অনুপ সাহাকে সে দিন কী ঘটেছিল প্রশ্ন করলে এখনও সরাসরি জবাব দিতে চান না। কারণ জানতে চাইলে ভীতু গলায় বলেন, ‘‘সে দিনের ভয়ের ঘোর আমার এখনও কাটেনি। ভরসন্ধ্যায় পাড়ার মধ্যে একটা মানুষ খুন হয়ে গেল! এখন সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বেরোতেও ভয় লাগছে। বাচ্চাদের টিউশন পড়াতে নিয়ে যাওয়াও বন্ধ রেখেছি!’’
অথবা রফিক মণ্ডল। তাঁর চোখেমুখেও ভয়ের ছাপ। রফিকের কথায়, ‘‘এর আগে কোনও দিন এমন ঘটনা আমাদের এখানে ঘটেনি। ওই রাস্তা দিয়ে সব সময় মানুষ যাতায়াত করে। রাস্তায় আলোও আছে। তবুও ওরা এত সাহস পেল কোথা থেকে! ভেবে এখনও ভয় করছে!’’
গত ২৪ নভেম্বর ভরসন্ধ্যায় শিবনগরে জলঙ্গি নদীর ফেরিঘাটের কাছে খুন হয়েছিলেন নদিয়ার থানারপাড়ার সাদিপুরের তৃণমূল নেতা মতিরুল বিশ্বাস। সেই ঘটনার পর পেরিয়ে গিয়েছে বেশ কয়েকটা দিন। কিন্তু শিবনগর এখনও ভয়ের চোটে কুণ্ডলী পাকিয়ে রয়েছে। মতিরুলের নিজের গ্রাম সাদিপুরেও ভয়। তাঁর মতো শাসকদলের ‘প্রভাবশালী’ নেতার খুনের ঘটনার পর সাধারণ ভাবে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত সাদিপুর।
দুয়ারে পঞ্চায়েত ভোট। তার আগে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে আসছে বিবিধ সন্ত্রাসের অভিযোগ। কোথাও খুন হয়ে যাচ্ছেন শাসকদলের নেতা। কোথাও বোমা বিস্ফোরণে হাত উড়ে যাচ্ছে রাজনৈতিক কর্মীর। কোথাও উদ্ধার হচ্ছে বোমার কারখানা। কোথাও উদ্ধার হচ্ছে মজুত রাখা বোমা।
ঘটনাচক্রে, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রের সঙ্গেই নাম জড়িয়ে যাচ্ছে শাসকদলের লোকজনের। অভিযোগের আঙুল উঠছে তাঁদের দিকেই। যদিও অধুনা তৃণমূলের সংগঠনের এক নম্বর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বারংবার বলেছেন, ‘‘কোথাও কোনও জোর-জবরদস্তি করে পঞ্চায়েত দখল করা চলবে না। বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত করতে হবে, এমন কোনও কথাও নেই। পঞ্চায়েত ভোট সুষ্ঠু এবং অবাধ হতে হবে।’’
বলেছেন বটে অভিষেক। কিন্তু তাঁর নির্দেশ যে অক্ষরে অক্ষরে মানা হচ্ছে, এমন কথা হলফ করে তৃণমূলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারাও বলতে পারছেন না। কারণ, তাঁরা আবার অনেকেই ‘বিরোধীশূন্য’ তত্ত্বের প্রবক্তা। গণতন্ত্রে বিরোধীদের সঙ্গে শাসকদলের রাজনৈতিক সংঘাতের বাতাবরণ স্বাভাবিক। কিন্তু এই চিত্র ব্যতিরেকে আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ্বের আবর্ত শুরু হয়েছে রাজ্যের শাসকদলের অন্দরেও। সেই পরিস্থিতি উত্তরবঙ্গে এখনও পর্যন্ত সে ভাবে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু দক্ষিণবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনে লড়াইয়ের কৌশল নিয়ে শাসকদলের মধ্যেই শুরু হয়েছে মন্থনপর্ব।
পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলের কৌশল কী হবে, তা আগে থেকেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক। এখনও নিয়ম করে রাজ্যের বিভিন্ন জনসভা থেকে দলীয় নেতা-কর্মীদের সংযমের পাঠ দিয়ে আসেন মমতা এবং অভিষেক দু’জনেই। জেলা সফরে গিয়ে সেই বার্তা দেন তৃণমূলের দায়িত্বপ্রাপ্ত বহু শীর্ষনেতাও। কিন্তু গাইডলাইন স্থির হলেও সেই নিয়ন্ত্রণরেখা ভাঙার প্রবণতাও রয়েছে। ফলে একই দলে একই বিষয় নিয়ে ভিন্ন ছবি তৈরি হচ্ছে। তাতে বাড়ছে ধোঁয়াশা। তৈরি হচ্ছে ক্ষতও।
দলে থেকেও ‘বিরোধী স্বর’-এর সেই তালিকায় বারে বারেই ঢুকে পড়ছেন মদন মিত্র। পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে বিরোধীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে অতি সম্প্রতি বিতর্কে জড়িয়েছেন মদন। তবে তৃণমূলের একটি অংশের দাবি, মদন যা বলতে চাইছেন তা আসলে দলেরই একটি অংশের কণ্ঠস্বর। সেই অংশটি চায় বিরোধীদের দমিয়ে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের অধিকাংশ আসন দখল করতে। যাতে পঞ্চায়েতের নানা প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে থাকে। পাশাপাশিই হাতে থাকে গ্রামীণ রাজনীতির রাশও। সেই কারণেই কোথাও কোথাও তৈরি হচ্ছে পঞ্চায়েত ভোটে ‘গাজোয়ারি’ করার মনোভাব। যে মনোভাব থেকে শহরের ভোটেও দাপাদাপি করতে দেখা যায় শাসক শিবিরের একটি অংশকে। যদিও চলতি বছরে পুরভোটে এমন গাজোয়ারির অভিযোগ তুলনায় কম উঠেছিল।
দাপটের কৌশল যে ‘ব্যুমেরাং’ হয়ে উঠতে পারে, তার অতীত অভিজ্ঞতা অবশ্য রয়েছে তৃণমূলের। রাজ্যের শাসকদল হিসাবে বার বার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও তৃণমূলকে বিভিন্ন সময়ে যে সব পরীক্ষাপর্ব পেরোতে হয়েছে বা হচ্ছে, তার নজির বিশেষ মেলে না। ২০১৬ সালে রাজ্যে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল। সেই সময় তাদের আসন সংখ্যা ছিল ২১১। এর বছর দু’য়েকের মধ্যে ২০১৮ সালে রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঢাকে কাঠি পড়ে। তখন ভোটের আগেই রাজ্যের ২০ হাজারের বেশি আসনে জয়ী হয়ে যায় তৃণমূল। পঞ্চায়েতের তিনটি স্তর মিলিয়ে প্রায় ৩৪ শতাংশ আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পেয়েছিলেন শাসকদলের প্রার্থীরাই। যা রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোটের ইতিহাসে ‘রের্কড’। তখন বিরোধী সিপিএম এবং বিজেপি বার বার অভিযোগ করেছিল তৃণমূল স্তরে তৃণমূলের ‘দখলদারি’ চালানোর মেজাজ নিয়ে। তবে বাম আমলেও রাজ্যে বিরোধীদের গলায় বার বার একই অভিযোগ শোনা গিয়েছে। সেই বিরোধী স্বরের অন্যতম মুখ ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আবার ২০১৮ সালে ত্রিপুরার পঞ্চায়েত ভোটে সেখানকার শাসকদল বিজেপির বিরুদ্ধে ‘দখলদারি’র অভিযোগ তুলেছিল বামেরাই। তখন ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের প্রায় ৯৬ শতাংশ আসন বিনা লড়াইয়ে দখল করেছিল বিজেপি। ভোট জয়ের ক্ষেত্রে এ দেশের ইতিহাসে সে-ও এক অনন্য ‘মাইলফলক’!
কিন্তু ২০১৮ সালে পঞ্চায়েতে ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ তৃণমূলের সেই জয়ের ‘নেতিবাচক’ ছাপ পড়েছিল ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে। রাজ্যের ৪২টি আসনের মধ্যে ১৮টি দখল করেছিল বিজেপি। সেই সূত্রেই ২০২১ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় আসার বিষয়ে আশাবাদী হয়েছিল গেরুয়া শিবির। যদিও মমতা তাদের লোকসভার জয়যাত্রা কার্যত একার হাতে রুখে দিয়েছিলেন।
২০১৯ সালে ভোট-বিপর্যয়ের ময়নাতদন্তে জোড়াফুল শিবির বুঝেছিল, তার অন্যতম কারণ ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোট। পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট দিতে না পারার ‘প্রতিশোধ’ ভোটাররা লোকসভায় মিটিয়ে নিয়েছেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর ঘেরাটোপে থেকে। সেই আবহে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে এই পঞ্চায়েত ভোটে ২০১৮-র ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি চাইছে না তৃণমূল।
নির্বাচনী ইতিহাস বলে, যে কোনও শাসকের তূণীরে মূলত তিনটি তির থাকে। প্রথম, দণ্ড। অর্থাৎ কঠোর ভাবে বিরোধী স্বর দমন করা। দ্বিতীয়, ভোটারের মন জয় করা। তৃতীয়, দুই কৌশলের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে এগিয়ে যাওয়া। রাজ্যে গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো একের পর এক ‘জনমুখী’ প্রকল্প সামনে এনে বিরোধীদেরও একাংশের মন জয় করেছে মমতার সরকার। যার প্রভাব পড়েছিল বিধানসভা ভোটের ফলাফলে। অঙ্ক বলছে, রাজ্যের ৪৮ শতাংশের বেশি ভোট এখন তৃণমূলের দখলে। তৃতীয় বার ক্ষমতা দখলের পর রাজ্যে যে ক’টি নির্বাচন হয়েছে, তাতে ভোটের স্বাভাবিক গতি দেখা গিয়েছে শাসকদলের পক্ষেই। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতেও পঞ্চায়েত ভোটের আগে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হিংসা, বোমা-অস্ত্র উদ্ধার ইত্যাদির মতো ঘটনা ঘটছে। বিরোধীরা আঙুল তুলছে তৃণমূলের দিকেই।
তৃতীয় বারের জন্য রাজ্যের ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই ‘টানাপড়েন’ থেকে দলকে বার করে আনাটাও জোড়াফুল শিবিরের শীর্ষ স্তরের নেতৃত্বের কাছে চ্যালেঞ্জ। পঞ্চায়েত ভোটের অনেক আগে থেকে দলীয় নেতা-কর্মীদের সতর্কবার্তা দিয়ে দলের লাইনের ভিত্তিপ্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা। তার বিরোধিতা হলে তা নিয়েও পরোক্ষে বার্তা দেওয়া হচ্ছে। মদন-বিতর্কে তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ যেমন বলেছেন, ‘‘অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যা বলেছেন, সেটাই পার্টির লাইন। অবাধ, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হবে। উন্নয়ন এবং পরিষেবার উপর দাঁড়িয়ে মানুষের কাছে ভোট চাইব।’’ (চলবে)
লেখা: কণাদ মুখোপাধ্যায়। তথ্য সংকলন: সৈকত ঘোষ, অমিতা দত্ত, সুমন মণ্ডল, মৌসুমী খাঁড়া, প্রণয় ঘোষ এবং তরুণিমা মণ্ডল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy