পোশাকশিল্পী সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়ের কর্মজীবন ২৫ বছর পূর্ণ করল। তাঁকে নিয়ে হইচই দেশ জুড়ে। বিদেশেও তাঁর কাজ প্রশংসিত হয়েছে। তবে ফ্যাশনজগতে খ্যাতির শীর্ষে থাকা সেই মানুষটি আদতে কলকাতার। তাঁর এই দীর্ঘ পথ চলার উদ্যাপন উপলক্ষে সম্প্রতি বিশেষ এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল মায়ানগরীতে।
সব্যসাচীর কাজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বাঙালি ঐতিহ্য, সংস্কৃতি। একই সঙ্গে তাঁর সৃষ্ট ছবিতে ধরা পড়ে শিকড়ের প্রতি অমোঘ টান। পোশাকের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে পুরনো কলকাতার অলিগলি, নোনা ধরা দেওয়াল, কড়িকাঠ, ঝুলবারান্দা, খড়খড়ি, ট্রামলাইন, কফিহাউস, বইপাড়া, হাতেটানা রিকশা, নিউ মার্কেট আর রবি ঠাকুর। ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে মুম্বইয়ে আয়োজিত বিশেষ সেই অনুষ্ঠানে মার্জারসরণিতে হেঁটেছেন বলিউডের অভিনয় তাবড় নক্ষত্রেরা। কিন্তু আবহে যাঁর কণ্ঠ শোনা গিয়েছে, তিনি কলকাতার মেয়ে। নাম আইভি বন্দ্যোপাধ্যায়। খেয়াল, ঠুমরী গাইয়ে হিসাবে শহরে পরিচিত রয়েছে। ২৫ বছরের উদ্যাপন উপলক্ষে পোশাকশিল্পী সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা আনন্দবাজার অনলাইনকে জানালেন আইভি।
প্রশ্ন: সব্যসাচীর পোশাক পরে মডেলরা হেঁটে আসছেন, আবহে আপনার গান বাজছে। শুনে কেমন লেগেছিল?
আইভি: গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। এখনও আমি বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছিল, স্বপ্ন দেখছি না তো? দাদার সঙ্গে কাজ আমার এই প্রথম নয়। তবু যেন স্বপ্ন মনে হয়। ওঁর ওই বিশালতার কাছে কেমন যেন খেই হারিয়ে ফেলি।
প্রশ্ন: সব্যসাচীর সাজানো বাগানে ‘আইভি’লতা ফুটল কবে?
আইভি: সে তো অনেক দিক আগে। প্রায় সাত-আট বছর আগে হঠাৎ এক দিন দাদার কলকাতার অফিস থেকে ফোন এল। সেখানে আমাকে নির্দিষ্ট একটা দিনে যেতে বলা হয়েছিল।
প্রশ্ন: সেখানে পোশাকশিল্পী নিজে উপস্থিত ছিলেন?
আইভি: হ্যাঁ, সে দিন নির্দিষ্ট সময়ে ওঁর লেক রোডের অফিসে পৌঁছলাম। সেখানে ঢুকে কিছু ক্ষণ অপেক্ষা করার পর আমাকে একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। দেখলাম দাদা স্বয়ং সেখানে বসে আছেন। সরাসরি জানালেন, আমার গান তিনি শুনেছেন। এখন ওঁর কাজের জন্য কী ধরনের গান প্রয়োজন, তা-ও জানালেন।
প্রশ্ন: প্রথম কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?
আইভি: ভীষণ ভাল। দাদার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে কোনও দিন অসুবিধা হয়নি। কারণ, আমাদের মাঝে তো অন্য কেউ থাকেন না। গান বা গায়কি নিয়ে যা বলার আমাকে সরাসরি বলেন। আর ঠিক যা যা দাদা বলে দেন, আমি সেটুকুই গাই।
প্রশ্ন: গান কী ভাবে গাইতে হবে তা সব্যসাচী বলে দেন?
আইভি: একদম। ওঁর মাথায় গোটা ছবিটা আগে থেকে আঁকা থাকে। আর গানের ব্যাপারে তো ওঁর ভীষণ জ্ঞান। দাদা পোশাক নিয়ে কাজ করলেও ছোট ছোট সমস্ত বিষয়ে ওঁর নজর থাকে।
আরও পড়ুন:
প্রশ্ন: গানের সঙ্গে সব্যসাচীর পোশাকের যোগ কোথায়?
আইভি: সবটা যে পোশাকের সঙ্গে, তা নয়। গানের সঙ্গে ওঁর ভাবনা, ওঁর সৃষ্ট মেজাজের যোগ রয়েছে। পোশাক পরে মডেলরা কী করবেন, ক্যামেরায় কী দেখানো হবে, তার সঙ্গে কোন গান ভাল লাগবে— পুরো প্রক্রিয়াটা মাথায় চলতে থাকে।
প্রশ্ন: গান বাছাই তো হল, এ বার গায়কি?
আইভি: গানের শব্দ, লাইন ধরে ধরে বলে দেন, কেমন ভাবে গাইতে হবে, কোথায় থামতে হবে। আমি তো বরাবর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিয়েছি। কিন্তু দাদা প্রচলিত একটি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শুনিয়ে হয়তো বললেন, এই গানটা এমন ভাবে গাইতে হবে যেন আমি কোনও দিন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখিইনি।
প্রশ্ন: গান গাওয়ার আগে মডেলদের অভিব্যক্তি বা কোনও ভিডিয়ো দেখানো হয়?
আইভি: না। আমার কাছে দাদা ঈশ্বরতুল্য। আমি সবটা ওঁর চোখ দিয়েই দেখি। মুখে মুখে আমাকে যেমন ভাবে বলে দেন, আমি ঠিক তেমন ভাবে গেয়ে দিই।
প্রশ্ন: বিশেষ এই অনুষ্ঠানের জন্য বিশেষ ভাবে গান বাছাই পর্ব হয়েছিল?
আইভি: খুব সময় নিয়ে আলাদা করে কিছু হয়নি। সবটা আগে থেকে ভেবে রাখা ছিল। দাদা বললেন, ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন’ গাইতে হবে। কী ভাবে গাইতে হবে, তা-ও বলে দিলেন। গাইতে গিয়ে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম।
প্রশ্ন: গান রেকর্ডিং করার সময়ে স্টুডিয়োতে সব্যসাচী উপস্থিত থাকেন?
আইভি: (খুব হেসে) সেটা বলা যাবে না। তবে এটুকু বলতে পারি দাদার তত্ত্বাবধানেই সমস্তটা হয়। আমি শুধু নির্দিষ্ট স্টুডিয়োতে গিয়ে গানটা গেয়ে চলে আসি। তার পর কাটাছাঁটা যা করার, দাদা বুঝে নেন।
প্রশ্ন: মুম্বইয়ে অনুষ্ঠানের দিন, এত তারকার ভিড়ে কাকে সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছে?
আইভি: (উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে) সে তো একেবারে চাঁদের হাট! সকলেই ঝকঝকে। কাকে ছেড়ে কার কথা বলব! তবে সামনে থেকে সে দিন আলিয়া ভট্ট এবং শাবানা আজ়মিকে অসামান্য দেখাচ্ছিল। দীপিকা পাড়ুকোন যে আসবেন, তা আগে থেকে আমরা কেউ জানতাম না। দেখে চমকে উঠেছি।
প্রশ্ন: এত বছর ধরে সব্যসাচীর কাজ করছেন, স্মরণীয় মুহূর্ত রয়েছে?
আইভি: হ্যাঁ, যে দিন কলকাতার অফিসে গিয়েছিলাম গান শোনাতে। নানা ধরনের ঠুমরি শোনাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি দাদা কাঁদছেন। সেখানে উপস্থিত সকলের চোখেই জল। ব্যস, সে দিনই আমার সব পাওয়া হয়ে গিয়েছিল। আমার আর কিছু চাই না। এ আমার সারা জীবনের প্রাপ্তি।