কাজ বন্ধ, সুনসান কারখানা চত্বর। মঙ্গলবার তোলা নিজস্ব চিত্র।
এ কারখানা চালুর পিছনে বড় ভূমিকা রয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তখন তিনি প্রথম ইউপিএ সরকারের রেলমন্ত্রী। কিন্তু, কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই বারবার তাঁর নিজের দলের একাংশের বিক্ষোভের মুখে পড়ছে কুলটির ওয়াগন কারখানা। মূলত ট্রেনের রেক সংস্কারের কাজে স্থানীয় শ্রমিকদের নিয়োগের দাবিতেই তৃণমূলের কিছু লোক এই বিক্ষোভে ইন্ধন দিচ্ছেন বলে অভিযোগ। মঙ্গলবারও সেই দাবিতেই কাজ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় ওই ওয়াগন কারখানায়।
কারখানা কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, বিক্ষোভকারীরা শ্রমিক-কর্মীদের কারখানায় ঢুকতে বাধা দেন। তা উপেক্ষা করে কারখানায় ঢুকতে চাইলে তাঁদের মারধরেরও হুমকি দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদ করায় কয়েকজন শ্রমিক-কর্মীকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়। বিক্ষোভকারীদের অনেকেই এলাকার পরিচিত তৃণমূল কর্মী-সমর্থক। এই ঘটনায় আতঙ্কিত কারখানার শ্রমিক-কর্মীরা উপযুক্ত নিরাপত্তা ছাড়া কাজে যোগ দেবেন না বলে জানিয়েছেন। কর্তৃপক্ষের তরফে থানায় মৌখিক অভিযোগ করা হয়েছে।
উৎপাদনশূন্য কুলটি ইস্কো কারখানায় রেল-সেলের যৌথ উদ্যোগে ওয়াগন কারখানা তৈরির প্রথম প্রস্তাব রেলমন্ত্রী থাকাকালীন দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঠিক হয়, কুলটি ইস্কোর বন্ধ হয়ে যাওয়া স্প্যান পাইপ বিভাগের জমিতে রেলের অধিগৃহীত সংস্থা রাইটস এবং সেলের যৌথ উদ্যোগে ওয়াগন কারখানা তৈরি করা হবে। ২০১০ সালের ৩০ অক্টোবর তিনি কারখানার শিলান্যাস করেন। কারখানার নাম দেওয়া হয় ‘সেল-রাইটস বেঙ্গল ওয়াগন ইন্ডাস্ট্রিজ প্রাইভেট লিমিটেড’। পরের বছর কারখানার ছাউনি তৈরি ও যন্ত্রাংশ বসানোর কাজে হাত পড়ে। সময় মতো সে সব শেষও হয়। কিন্তু, পাঁচ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও উৎপাদন শুরু না হওয়ায় হতাশা ক্রমেই গ্রাস করছিল শ্রমিক-কর্মী এবং এলাকার মানুষকে।
গত বছর অক্টোবরে ১৬ ওয়াগনের পুরনো একটি রেক পুননির্মাণের জন্য কারখানাকে বরাত দেয় রেল বোর্ড। স্বস্তি ফেরে সব মহলে। কিন্তু, সেই থেকে স্থানীয়দের নিয়োগের দাবিতে বারবার বিক্ষোভের জেরে কাজ বন্ধ হওয়াটা যেন রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে এখানে। কখনও দলীয় ঝান্ডা নিয়ে, কখনও ঝান্ডা ছাড়া। এ দিনও ঝান্ডা ছাড়া বিক্ষোভ দেখিয়েছেন এক দল লোক।
কারখানা সূত্রের খবর, শনিবার সকাল থেকে কারখানার গেটে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। প্রথম তিন দিন শ্রমিক-কর্মীদের কিছুক্ষণ আটকে রেখে কারখানায় ঢুকতে দেওয়া হয়। কিন্তু, মঙ্গলবার কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সকাল দশটা পর্যন্ত কারখানার গেটে বিক্ষোভ দেখিয়ে শ্রমিক-কর্মীদের বাড়ি পাঠিয়ে বিক্ষোভকারীরা এলাকা ছেড়ে চলে যান। কর্তৃপক্ষের দাবি, দিন পনেরো আগেও জনা কয়েক তৃণমূল সমর্থকের বিক্ষোভের মুখে শ্রমিক-কর্মীরা কাজে যেতে বাধা পান। সমস্যা মেটাতে তখন এলাকার দুই তৃণমূল কাউন্সিলর স্থানীয়দের নিয়োগের দাবিতে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করে জনা চল্লিশের একটি নামের তালিকা তুলে দেন। কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে বিক্ষোভ ওঠে। কিন্তু, এ দিন পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। সংস্থার ডিজিএম স্বপন বসু জানিয়েছেন, সংস্থায় এখন মোট ৫২ জন শ্রমিক-কর্মী কাজ করেন। এর মধ্যে ২৬ জনই স্থানীয় বাসিন্দা। বাকিরা সকলেই কারিগরি বিশেষজ্ঞ। তাঁদের বাইরে থেকে আনা হয়েছে।
এ দিন কারখানায় ঢুকে দেখা গিয়েছে, গোটা চত্বর খাঁ খাঁ করছে। শ্রমিক-কর্মীর দেখা মেলেনি। যন্ত্রপাতির আওয়াজ নেই। অফিসের সামনে দুশ্চিন্তায় জটলা করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সংস্থার জনা কয়েক আধিকারিক। কারখানার সিইও সুশান্ত ভট্টাচার্য জানালেন, বর্তমানে ১৩টি রেক সংস্কারের কাজ চলছে। কিন্তু, এক জনও শ্রমিক বা কর্মী কারখানায় ঢুকতে না পারায় গোটা দিন কোনও কাজ হয়নি। তাঁর আশঙ্কা, ‘‘আতঙ্কের মুখে কর্মীরা কাজে যোগ দিতে না পারলে সমস্যা বাড়বে। কারখানার ভবিষ্যৎই অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।’’ স্বপনবাবুর দাবি, ‘‘স্থানীয়দের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগানো হয়েছে। এর পরেও স্থানীয়দের নিয়োগের দাবিতে বারবার বিক্ষোভ ও উৎপাদন ব্যাহত করলে সময়মতো রেক তৈরি করা যাবে না। রেলবোর্ডও বরাত দিতে চাইবে না।’’ কারখানা সূত্রের খবর, বছরে ১২০০ ওয়াগন তৈরির ক্ষমতা সম্পন্ন এই সংস্থায় বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। এখনও পর্যন্ত ৩২টি পুরনো রেককে নতুন করে বানিয়ে সরবরাহ করা হয়েছে। খুব শীঘ্রই নতুন রেক তৈরি হবে। সেই কাজ শুরুর আগে আরও শ্রমিক-কর্মী নিয়োগ করা হবে। কিন্তু, বারবার বিক্ষোভে সব পণ্ড হতে বসেছে।
পরিস্থিতি বুঝে কারখানার কাজ সচল রাখতে তৎপর হয়েছেন কুলটির তৃণমূল বিধায়ক উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বক্তব্য, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বপ্নের এই ওয়াগন কারখানার উৎপাদন অব্যাহত রাখতে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সব রকমের সহযোগিতা করা হবে। আমিও শুনেছি তৃণমূলের নাম নিয়ে কেউ কেউ ঝামেলা পাকাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’’ তিনি জানান, নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার জন্য একজন বিধায়ক প্রতিনিধি ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। তৃণমূলের কুলটি ব্লক সভাপতি মহেশ্বর মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘দরকারে আমরাই পাহারা দিয়ে শ্রমিক কর্মীদের কাজে ঢুকতে সাহায্য করব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy