রাস্তায় আলুর বস্তা ফেলে চাষিদের বিক্ষোভ। বৃহস্পতিবার ভাতারে। ছবি: উদিত সিংহ।
কোন চাষির আলু হিমঘরে ঢুকবে আর কার ঢুকবে না, তা ঠিক করে দিচ্ছিলেন তৃণমূল নেতারাই। নেতাদের নাম লেখা ‘টোকেন’ যাদের পকেটে, শুধু তাদের জন্যই খুলছিল হিমঘরের দরজা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিয়েও সাধারণ চাষিরা হিমঘরে আলু রাখতে পারছিলেন না।
খেপে উঠে বৃহস্পতিবার চাষিদের একাংশ বর্ধমানের কয়েকটি হিমঘরের সামনে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। দুয়েক জায়গায় ছোটখাটো হামলাও হয়। এর পরেই নিরাপত্তার অভাবের কথা জানিয়ে গুসকরা লাগোয়া বেশ কয়েকটি হিমঘরে তালা ঝুলিয়ে দেন কর্তৃপক্ষ। আউশগ্রাম ও মঙ্গলকোটের পাঁচটি হিমঘর দিনভর বন্ধ ছিল। পরে পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকে ঠিক হয়, ‘আগে এলে আগে’ ভিত্তিতে আলু রাখার সুযোগ পাবেন চাষিরা। চাপ পড়ে ‘টোকেন’ বিলি করা তৃণমূল নেতাদের পিছু হটতে হয়।
অতিফলনের জেরে খোলাবাজারে আলুর দাম পড়তে থাকা ও হিমঘরে বাড়তি আলু রাখার যথেষ্ট জায়গা না থাকায় বর্ধমান-হুগলির মতো বেশ কিছু জেলার পরিস্থিতি এমনিতেই ঘোরালো হয়ে উঠেছে। রাজ্য সরকার সহায়ক মূল্যে আলু কেনা ও অন্যত্র রফতানিতে সাহায্যের আশ্বাস দিলেও এখনও মাঠে নামেনি। হিমঘরগুলির সামনে এক-দেড় কিলোমিটার পর্যন্ত আলুর গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিপর্যয়ে পড়ে আগেই হুগলি ও বর্ধমানের দুই চাষি আত্মঘাতী হন বলে অভিযোগ। মঙ্গলবার বর্ধমানের জামালপুরে ফের এক চাষি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। বুধবার মঙ্গলকোটের এক চাষির মৃত্যুর পরেও আলু চাষে বিপর্যয়ের দিকে আঙুল উঠেছে।
এই পরিস্থিতির ফায়দা নিতেই আউশগ্রাম ও মঙ্গলকোটের কিছু তৃণমূল নেতা আসরে নেমেছিলেন বলে অভিযোগ। তৃণমূল সূত্রের খবর, গত মঙ্গলবার রাতে তাঁরা কিছু হিমঘর মালিকের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে ঠিক হয়, তৃণমূল নেতারা নিজেদের নাম লেখা ‘টোকেন’ চাষিদের দেবেন। তা দেখিয়ে হিমঘরে আলু রাখার সুযোগ পাবেন চাষিরা। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী আগে এলে আগে হিমঘরে আলু রাখার যে সুযোগ চাষিরা পান, তা আর চলবে না।
ফল হয় মারাত্মক। হিমঘর মালিক সুশীল মণ্ডলের অভিযোগ, “আলু রাখার সুযোগ না পেয়ে চাষিরা হামলা চালান। গেট ভেঙে ভিতরে ঢুকে কর্মীদের মারধর করেন। নিরাপত্তার অভাবে কর্মীরা কাজ করতে চাইছেন না দেখে আমরা হিমঘর বন্ধ রাখতে বাধ্য হই।” হিমঘর মালিকদের বড় অংশেরই বক্তব্য, ‘টোকেন’ চালুই বিপত্তির কারণ। ঘন্টার পর ঘন্টা তাঁরা লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অথচ বুধবার সন্ধ্যা থেকে তৃণমূল নেতাদের নাম দেওয়া ‘টোকেন’ গেটে দেখিয়ে অন্যেরা ঝুকে যাচ্ছিল। তা দেখেই লাইনে থাকা চাষিরা খেপে ওঠেন।
প্রশ্ন হল, কেন এই নিয়মভঙ্গ?
বর্ধমান জেলা পরিষদের সদস্য তথা আউশগ্রাম ১ ব্লক তৃণমূল সভাপতি শেখ সালেখ রহমানের দাবি, “প্রান্তিক চাষিরাও যাতে হিমঘরে আলু রাখার সুযোগ পান, তার জন্যই টোকেন চালুর চিন্তা ভাবনা হয়েছিল।” নেতাদের নামে ‘টোকেন’ চালুর যুক্তি কী? সালেখের ব্যাখ্যা, “মঙ্গলকোট ও আউশগ্রামে মোট চার-পাঁচ জনের নামে ‘টোকেন’ করা হয়েছে, যাতে তা জাল হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে। তবে চাষিদের কাছ থেকে ‘টোকেন’ বাবদ টাকা নেওয়ার যে অভিযোগ উঠছে, সেটা ঠিক নয়।”
তৃণমূলের দেওয়া ‘টোকেন’। বৃহস্পতিবার মঙ্গলকোটে। —নিজস্ব চিত্র।
এ দিন বর্ধমান-সিউড়ি রাস্তায় আলুর গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কয়েক জন চাষির কাছে যে ‘টোকেন’ দেখা গিয়েছে, তার অনেকগুলোতেই ‘জয়ন্ত রায়, মঙ্গলকোট’ বলে ছাপ মারা। নামের উপরে লেখা ‘গুসকরা হিমঘর’, নীচে লেখা ‘৪০ প্যাকেট’। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই চাষিদের অভিযোগ, আলু রাখার জন্য গ্রামের তৃণমূল কর্মীদের কাছ থেকেই কুড়ি টাকা দরে ‘টোকেন’ কিনতে হয়েছে।
জয়ন্তবাবু মঙ্গলকোটের চাণক গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় দলের সভাপতি। তৃণমূল সূত্রের খবর, বুধবারের মধ্যেই তাঁর নাম দেওয়া ‘টোকেন’ কর্মীদের মারফত নানা গ্রামে পৌঁছে গিয়েছিল। এ দিন বিকেলে হিমঘর মালিকদের সঙ্গে বৈঠক সেরে ফেরার সময়ে তিনি অবশ্য ঘটনার দায় ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছেন। জয়ন্তবাবুর দাবি, “বড় চাষিরা আগে থেকে হিমঘরের সামনে লরি লাগিয়ে রাখায় প্রান্তিক চাষিরা বঞ্চিত হচ্ছিলেন। তাই পঞ্চায়েতের মাধ্যমে প্রান্তিক চাষিদের ‘টোকেন’ দেওয়ার কথা হয়েছিল। পরে আমার নামে কেউ ‘টোকেন’ করে নিয়েছে!”
প্রবীণ সিপিএম নেতা তথা জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক অমল হালদারের কটাক্ষ, “হিমঘরে আলু রাখা নিয়েও দলতন্ত্র! কৃষকদের মধ্যে এর ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়বে।” দায় এড়িয়ে রাজ্যের মন্ত্রী তথা তৃণমূলের জেলা সভাপতি (গ্রামীণ) স্বপন দেবনাথ বলেন, “ব্যক্তিগত স্তরে কে কোথায় কী করছে, তা মানা হবে না। সরকারের নির্দেশ মোতাবেক হিমঘরে আলু রাখা বা সরকারি স্তরে আলু কেনা হবে।”
তৃণমূলের অন্য একটি অংশও বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ। জেলা পরিষদের তৃণমূল সদস্য, আউশগ্রামের রুবি ধীবর বলেন, “আমরা টোকেন পদ্ধতি মানব না বলে আগেই প্রশাসনকে জানিয়েছিলাম। জেলা সভাপতিকেও পুরো বিষয়টি জানিয়েছি।” হিমঘর মালিক শিশির মণ্ডল বলেন, “ফের ঠিক হয়েছে, টোকেনে নয়, পুরনো পদ্ধতিতেই হিমঘর আলু নেবে।”
সহায়ক মূল্যে আলু কেনার দাবি
দাম মিলছে না ঠিক মতো। সহায়ক মূল্যে কেনাও শুরু হয়নি। এই অভিযোগে জেলায়-জেলায় আলুচাষিদের বিক্ষোভ চলছেই। বৃহস্পতিবার বর্ধমানের ভাতারে রাস্তায় আলু ফেলে বিক্ষোভ দেখালেন চাষিরা। ঘটনাস্থলে গেলে বিডিও-কে ঘিরেও বিক্ষোভ হয়। এ দিনই মেদিনীপুরে জেলাশাসকের অফিসের সামনে রাস্তায় আলু ছড়িয়ে বিক্ষোভ দেখান কিছু চাষি। হুগলির পান্ডুয়ায় বিজেপি ও নালিকুলে কৃষকসভা পথ অবরোধ করে। কৃষি দফতরের এক কর্তা এ দিন দাবি করেন, এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী চাষিদের বন্ড বেনামে কিনে নেওয়ার চেষ্টা চালানোয় বর্ধমানের মতো কিছু জেলায় সমস্যা হচ্ছে। এ ব্যাপারে নজর রাখার জন্য নবান্ন থেকে জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া এ দিন দাবি করেন, “আবেগ নয়, আলুর সঙ্কট সমাধানে চাই বাস্তবের উপর দাঁড়ানো বিজ্ঞানসম্মত নীতি। উৎপাদন, সংরক্ষণ এবং বাজারের চাহিদা দেখে সুস্পষ্ট আলু নীতি প্রণয়ন করা দরকার।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy