Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

স্কুলছুট রুখতে ক্লাসে সাঁওতালি ভাষার দাবি

‘সুপ্রভাত’— শিক্ষকের মুখে এমন সম্ভাষণ শুনে খানিক হকচকিয়ে গিয়েছিল গোটা ক্লাস। খানিক বাদে শিক্ষক ‘নাপায় সেতাঃ’ (সুপ্রভাত) বলতেই সমস্বরে জবাব এল পড়ুয়াদের কাছ থেকে।

কেদারনাথ ভট্টাচার্য ও অর্পিতা মজুমদার
কালনা ও দুর্গাপুর শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০১:৪০
Share: Save:

‘সুপ্রভাত’— শিক্ষকের মুখে এমন সম্ভাষণ শুনে খানিক হকচকিয়ে গিয়েছিল গোটা ক্লাস। খানিক বাদে শিক্ষক ‘নাপায় সেতাঃ’ (সুপ্রভাত) বলতেই সমস্বরে জবাব এল পড়ুয়াদের কাছ থেকে। দৃশ্যটা একটি আদিবাসী স্কুলের। বর্ধমান জেলা পরিষদের তরফে জানানো হয়েছে, জেলার ১৩৫টি আদিবাসী স্কুলে ছাত্রদের পড়া বোঝাতে সাঁওতালির তুলনায় বাংলা ভাষারই ব্যবহার বেশি করেন শিক্ষকেরা। আর এর জেরে বিপাকে পড়ছে পড়ুয়ারা। এমনকী ‘ভাষা-ভীতি’র কারণে স্কুলছুটের সংখ্যাও বাড়ছে বলে দাবি অভিভাবকদের।

সম্প্রতি গলসির উচ্চগ্রাম এলাকায় ‘মিশন নির্মল বাংলা’ অভিযানে যান জেলা পরিষদের সভাধিপতি দেবু টুডু। সেখানেই চরকডাঙা আদিবাসী প্রাথমিক স্কুলে গিয়ে দেবুবাবু দেখেন ভরা ক্লাস। কিন্তু পড়ুয়ারা প্রায় সকলেই সাঁওতালিতে কথা বলছে। কেউ বাংলায় কিছু বললেই থেমে যাচ্ছে আলোচনা। কালনার সুলতানপুরের পরেশ মাণ্ডি, মেমারির চম্পা মাণ্ডিদের মতো বেশ কয়েক জন অভিভাবক জানান, শুধুমাত্র ‘ভাষা-ভীতি’র কারণে অনেকে মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দিচ্ছে। ওই স্কুলের শিক্ষকদের ক্লাসে যত বেশি সম্ভব সাঁওতালি ভাষায় কথা বলার পরামর্শ দেন দেবুবাবু।

ক্লাসে সাঁওতালি ভাষা ব্যবহারের দাবি উঠেছে দুর্গাপুরের ফুলঝোড়ের পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু আদিবাসী আবাসিক স্কুলেও। অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরের উদ্যোগে ২০০৫ সালে তৈরি এই স্কুলে পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা হয়। বর্ধমান, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রায় ৩০০ পড়ুয়া রয়েছে এখানে। স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শ্রাবণী সেনশর্মা জানান, স্কুলে সাঁওতালি ভাষাতেই কথা বলে পড়ুয়ারা। দু-এক জন শিক্ষক ওই ভাষা বলেন। ভাষাগত সমস্যাটা স্কুলের নীচু ক্লাসগুলিতে বেশি দেখা যায় বলে শিক্ষকেরা জানান। পড়ুয়াদের দাবি, সাঁওতালি ভাষার ব্যবহার বেশি হলে শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কও আরও ভাল হবে। স্কুলের পড়ুয়া বাঁকুড়ার ছাতনার বরেণ মান্ডি, বামুনাড়ার গণেশ হেমব্রমেরাও বলে, ‘‘ক্লাসে স্যারেরা যদি সাঁওতালি ভাষা আর অলচিকি হরফের ব্যবহার যদি আরও বেশি করে করেন, তা হলে পড়তে আরও ভাল লাগবে।’’

কাঁকসার রঘুনাথপুরে রয়েছে একলব্য আদিবাসী আবাসিক স্কুল। এই স্কুলে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা হয়। এই স্কুলেও দু’জন মাত্র শিক্ষক মাঝেসাঝে পড়ুয়াদের সঙ্গে সাঁওতালিতে কথা বলেন বলে জানান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আজিজুল হক মির্দ্দা।

স্কুলগুলির সূত্রে জানা গিয়েছে, ক্লাসে সাঁওতালি ভাষার ব্যবহার তেমন না হওয়ায় পড়ুয়াদের বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় বুঝতে বেশি সমস্যা হচ্ছে। বাংলা ভাষায় স্বাধীন ভাবে কিছু লিখতে গেলেও বেগ পেতে হচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে জেলার বিভিন্ন আদিবাসী স্কুলে আগামী সপ্তাহে বুধবার থেকে পরিদর্শন করা হবে বলে জেলা পরিষদ সূত্রের খবর। দেবুবাবু বলেন, ‘‘স্কুলগুলিতে ঘুরে পড়ুয়াদের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সমাধানের চেষ্টা করা হবে।’’

সমস্যা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য, ভাষাবিদ পবিত্র সরকার বলেন, ‘‘প্রাথমিক স্তরে পড়ুয়াদের পরিভাষা-সহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা তৈরির সময়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় মাতৃভাষা ব্যবহার না করলে সেই ধারণাগুলি স্পষ্ট হয় না, যা ভবিষ্যতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।’’

অন্য বিষয়গুলি:

School dropout Stop Regional language
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE