ফাঁকা জ্যোৎসাদি গ্রাম, চলছে পুলিশের টহল। —নিজস্ব চিত্র।
গ্রামটা যেন পিছু হেঁটেছে পাঁচ বছর। বৃহস্পতিবার ওসি সঞ্জয় রায়কে মারধর, তারপর থেকে টানা পুলিশি টহলে রায়নার জ্যোৎসাদি গ্রাম বিধ্বস্ত।
সকালে গ্রামে যেতে ইতিউতি দু’একটা মুখ দেখা গেলেও কেউই রাতে কয়রাপুর ক্যানেলে ওসিকে মারধরের ঘটনা নিয়ে মুখ খুলতে চাননি। শুধু জানান, রাতেই গ্রাম মোটামুটি পুরুষশূন্য হয়ে গিয়েছে। তারপরেও যে ক’জন ছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগকেই পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছে। ফলে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে গ্রাম জুড়ে। আতঙ্ক এতটাই যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের স্কুলগুলিতে পড়ুয়াদের দেখা মেলে নি। বাধ্য হয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ মাঝপথে ছুটি দিয়ে দেয়। পরিস্থিতি দেখে গ্রামের প্রবীণেরা বলেন, “ঠিক পাঁচ বছর আগে পুলিশের গুলিতে আমাদের গ্রামের এক জন মারা গিয়েছিলেন। তখনও একই রকম আতঙ্কের দৃশ্য দেখেছিলাম।’’
এমনিতেই বেশ কয়েক দিন ধরেই রায়না উত্তপ্ত হচ্ছিল। কখনও তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে খুন হয়েছেন রায়না ২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি আব্দুল আলিম তো কখনও সিপিএমের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন তৃণমূলের প্রবীণ কর্মী। এ ছাড়াও সিপিএমের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে হামলা চালানোয় অভিযুক্ত হয়েছে তৃণমূল। আবার সিপিএমের উপর হামলা করতে এসে তৃণমূলই পিছু হটেছে— এমন দৃশ্যও দেখেছে রায়না। তবে শুধু রায়না নয়, দক্ষিন দামোদর এলাকার খণ্ডঘোষ, মাধবডিহি ও জামালপুরেও তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব দিন দিন বাড়ছে। তৃণমূলের একটা সূত্রই জানাচ্ছে, তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের সুযোগে সিপিএম ধীরে ধীরে দক্ষিণ দামোদর এলাকায় জাগছে। আর তাতেই পরপর সংঘর্ষ বাধছে দক্ষিণ দামোদর এলাকায়।
বর্ধমান জেলা তৃণমূলের নেতারাও মনে করেন, বৃহস্পতিবার রাতে রায়না থানার ওসির উপর আক্রমণের ঘটনা স্থানীয় হিজলনা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার গোষ্ঠীদ্বন্দ্বেরই ফল। দলের এক নেতা বলেন, “হিজলনা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় মানিক শেখ ও নূরুল শেখ বলে তৃণমূলের দুই নেতা আছেন। দামোদরের বালি খাদান নিয়ে দু’জনের মধ্যে দ্বন্দ্ব। এই দু’জনকেই নিয়ন্ত্রণ করতেন বর্ধমান জেলা কমিটির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক বামদাস মণ্ডল।” পুলিশ জানিয়েছে, এই বালি খাদান নিয়েই মানিক শেখের সঙ্গে মনোমালিন্য হয় বামদাসবাবুর। তারপরেই বোমা মজুত রাখার অভিযোগে পুলিশ মানিক শেখের নামে মামলা দায়ের করে। তার ফলে মানিক শেখ ও তার দলবল গ্রাম ছাড়া হয়। এমনকী কিছু দিন আগে জামিন পাওয়ার পরেও বামদাসবাবুর অনুগামী জ্যোৎসাদি গ্রামের নুরুল শেখের বাধায় মানিক শেখ নিজের বাড়ি বেলসরে ঢুকতে পারছিলেন না বলে জানা গিয়েছে।
তৃণমূল ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, রায়না থানায় পুলিশের সঙ্গে বৈঠকের পর মানিক শেখকে গ্রামে ঢোকার ব্যাপারে অনুমতি দিয়েছিল বামদাসবাবু। যা নিয়ে অনুগামীদের সঙ্গে অশান্তিও হয় তাঁর। সেই সময় তিনি অনুগামীদের জানিয়েছিলেন, রায়না থানার ওসি সঞ্জয় রায়ের অনুরোধ তিনি মানতে বাধ্য হচ্ছেন। এর পরেই দিন পাঁচেক আগে মানিক শেখ-সহ ৮ জন গ্রামছাড়া বাড়িতে ঢোকেন। তৃণমূলের একাংশের দাবি, তখন থেকেই নুরুল গোষ্ঠীর লোকেদের ধারণা হয়, হিজলনা এলাকার দামোদরের বালি খাদানের ‘নিয়ন্ত্রক’ মানিক শেখকে ওসি মদত দিচ্ছেন। তখন থেকেই ওসি-র উপর রাগে ফুঁসতে শুরু করেন তাঁরা। পুলিশেরও ধারণা, এ সব কারণেই কোনও রকম প্ররোচনা ছাড়াই ওসিকে আক্রমণ করেন তৃণমূলের ওই গোষ্ঠীর লোকেরা।
এ দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, চাপ রক্তের চিহ্ন স্পষ্ট। এলাকায় দোকানপাট সব বন্ধ। চায়ের দোকান পর্যন্ত খোলেনি। কয়েকজন বাচ্চা ছেলে আর বয়স্ক ছাড়া এক জন পুরুষের দেখা পাওয়া কষ্টকর। মহিলারা একযোগে অভিযোগ করেন, অন্তত ২০০ জন পুলিশ সারারাত গ্রাম কাঁপিয়ে বেড়িয়েছে। প্রতিটি বাড়ির ভিতর ঢুকে পুলিশ অভিযুক্তদের খুঁজেছে। যাকে পেয়েছে তাঁকেই ধরেছে পুলিশ বলেও গ্রামবাসীদের অভিযোগ। তাঁদের আরও অভিযোগ, বেশ কয়েকটি বাড়ির ভিতর ঢুকে পুলিশ ভাঙচুর চালিয়েছে। রাস্তার ধারে একটি বাড়ির কাঁচের জানলা ও একটি ছোট যাত্রীবাহি গাড়ি পুলিশ ভাঙচুর করেছে। গ্রামবাসী রিনা বেগম, আনোয়ারা বেগমরা বলেন, “পুলিশের দাপাদাপিতে আমরা আতঙ্কিত। বাড়ির বাচ্চারে এখনও কাঁদছে। ভয়ে স্কুল পাঠাতে পারিনি। অবস্থা এমনই যে, আমরা রোজা শুরুর আগে, ভোরের খাবার পর্যন্ত খেতে পাইনি।” স্থানীয় এক ইমাম বলেন, “পুলিশের কাছে আমরা দাবি করেছি, নিরীহ মানুষরা যেন শান্তি থাকতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে।” পুলিশ যদিও এই সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
অন্য দিকে বর্ধমান জেলা আদালতে রায়না থানার তৃণমূলের ‘আহ্বায়ক’ বামদাস মণ্ডলের আত্মীয় শ্যামাশঙ্কর হাজরা বলেন, “ব্লকের আহ্বায়ক হওয়ার পর থেকেই বামদাসের উপর চক্রান্ত করছেন দলের নেতারা। তিনি চক্রান্তের শিকার।” তবে মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের দাবি, ‘‘বামদাসবাবুর দলের তরফে এমন কোনও দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy