বন্ধ মিষ্টির দোকান। —নিজস্ব চিত্র।
বিকেল হলেই যে দোকানের বাইরে জনা পঞ্চাশেকের লাইন পড়ে, সে দোকানের ঝাঁপ বন্ধ। দেখলে কে বলবে, এটা সন্তোষ ময়রার দোকান।
সাত সকালে এক সঙ্গে বাড়ি থেকে বাবা-মা-মেয়ের দেহ মেলায় থম মেরে গিয়েছেন পড়শিরা। দিশেহারা মঙ্গলকোটের নতুনহাটের নাগ পরিবারও। সবারই দাবি, স্ত্রী মণিমালাদেবী ও মেয়ে সুদর্শনাকে নিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার ছিল সুজলবরণ নাগের। স্ত্রী-মেয়েকে খুন করে তিনি আত্মঘাতী হয়েছেন বলে পুলিশ প্রাথমিক ভাবে জানালেও তা মানতে পারছেন না তাঁরা।
তবে ঘটনার কারণ নিয়ে ধোঁয়াশা থেকেই যাচ্ছে। শ্বাসকষ্টে ভোগা বছর বাষট্টির বৃদ্ধের পক্ষে স্ত্রী, মেয়ের শ্বাসরোধ করা সম্ভব কি না, অথবা চিৎকার, গোঙানির শব্দটুকুও কী ভাবে কেউ পেলেন না, সে প্রশ্ন উঠছে। পুলিশের যদিও দাবি, হতে পারে ঘুমন্ত অবস্থায় বা স্ত্রী, মেয়ের সম্মতিতেই তাদের খুন করা হয়েছে। তবে ময়না-তদন্তের রিপোর্ট হাতে না এলে কিছুই স্পষ্ট বলা যাবে না, তাও জানিয়েছে পুলিশ।
সুজলবাবুর ভাই হিমানীশবাবু, রথীন্দ্রবাবু, বোন দেবযানীদেবীরা জানান, মিষ্টির দোকানের আয় থেকেই মূলক যৌথ সংসার চলচ তাঁদের। পালা করে রান্না করতেন বাড়ির বউরা। বৃহস্পতিবার রাতেও সবার জন্য লুচি-তরকারি করেছিলেন মণিমালাদেবী। ১০টা নাগাদ নিজেদের খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকে যান। বাকিরা দোতলা-তিনতলায় থাকেন। তাঁরাও যে যার ঘরে চলে যান। সকালে ভাগ্নে অরূপ ডাকাডাকি করে সুজলবাবুকে না পেয়ে দরজা ধাক্কায়। তখনই খাটে সুদর্শনা, মেঝেতে মণিমালাদেবী ও ফ্যান থেকে ঝুলন্ত সুজলবাবুর দেহ দেখে সে।
পড়শিরা জানান, তিন পুরুষ ধরে ওই এলাকায় বাস সুজলবাবুদের। সুজলববাবুর জিলিপিও বিখ্যাত। পড়শি এক বৃদ্ধা জানান, ‘‘কোনও দিন বই ছাড়া দোকানে আসতেন না উনি। হয় গোয়েন্দা গল্প, নয়তো কোনও পত্রিকা পড়তেন কাজের ফাঁকে।’’ ওই বাড়ির নীচে মিষ্টির দোকান ছাড়াও একটি প্লাইউড, কাচের দোকান রয়েছে। সুজলবাবুর খুড়তুতো বাইয়েরা চালান সেটি। একই বাড়িতে থাকেন সবাই। সবার বড় সুজলবাবুই সংসারটা বেঁধে রেখেছিলেন বলে পড়শিদের দাবি। তাঁরা জানান, সকালে জোকান খুলে রস জাল দিতে, ছাঁচ বানাতে দেখা যেত তাঁকে। সাদাসিধে মানুষ ছিলেন। মেয়ে সুদর্শনার বিয়েও ঠিক হয়েছিল ফেব্রুয়ারিতে। তবে ভেঙেও যায় তা। পড়শিদের দাবি, সুদর্শনা মাঝেমধ্যেই একটু অস্বাভাবিক আচরণ করত। বাড়ি থেকে তেমন বেরোত না। তবে গান গাইত ভাল। টুকটাক এলাকার অনুষ্ঠানে গানও গাইত সে। তবে তার মানসিক স্থিতি না থাকা নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলতে চাননি বাড়ির লোকেরা। সেই কারণেই বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল কি না জানা যায়নি তাও।
বছর কুড়ির সুদর্শনার বান্ধবী, ওই পাড়ারই এক তরুণী বলে, ‘‘বিয়ের ব্যাপারে বেশি কিছু কখনও বলেনি তিন্নি (সুদর্শনা)। বিয়ের খুব ইচ্ছেও বোধহয় ছিল না। তবে হবু বরের সঙ্গে ফোনে কথা হতো বলে শুনেছি।’’ সুজলবাবুর বোন দেবযানীদেবীর দাবি, ‘‘পাত্রপক্ষের পৌষমেলা দেখতে এ বাড়িতে আসার কথা ছিল। ওই দিন বিয়ের যৌতুকের আসবাব বাবদ কিছু টাকা দেওয়ারও কথা ছিল। দাদা টাকা তুলেছিলেন বলেও জানি।’’
তাহলে কি প্রস্তুতি নিয়ে নেওয়ার পরে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার ধাক্কা মেনে নিতে পারেননি সুজলবাবু, না কি টাকাপয়সা বা অন্য কোনও সমস্যা ছিল— স্পষ্ট নয় কোনওটাই। শুধু তিন জনকে হারিয়ে থমথমে পাড়া-বাড়ি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy