Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

দালাল বিনা গতি নেই, ভোগান্তি

ওই তালিকার ‘ফাঁদ’ এড়িয়ে ন্যূনতম চিকিৎসা থেকে নার্সিংহোমে ভর্তি, বর্ধমানের বুকে ‘বিরলতম’ ঘটনা। শুধু রোগীর পরিজনেরাই নন, একান্তে এ কথা মানেন চিকিৎসক থেকে নার্সিংহোমের মালিকদের একাংশও।

নার্সিংহোমের সামনে দেখা যায় এমন ‘সতর্কবাণী’ও। নিজস্ব চিত্র

নার্সিংহোমের সামনে দেখা যায় এমন ‘সতর্কবাণী’ও। নিজস্ব চিত্র

সৌমেন দত্ত
বর্ধমান শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০১:৪৬
Share: Save:

চায়ের দোকানের মালিক, ওষুধের দোকানের কর্মচারী থেকে টোটো চালক, অ্যাম্বুল্যান্স চালক— কে নেই তালিকায়। তালিকাটি, স্বাস্থ্য-ক্ষেত্রের দালালদের, অন্তত এমনটাই অভিযোগ বর্ধমান শহরে চিকিৎসা করাতে আসা রোগীর পরিজনদের।

তাঁদের অভিযোগ, ওই তালিকার ‘ফাঁদ’ এড়িয়ে ন্যূনতম চিকিৎসা থেকে নার্সিংহোমে ভর্তি, বর্ধমানের বুকে ‘বিরলতম’ ঘটনা। শুধু রোগীর পরিজনেরাই নন, একান্তে এ কথা মানেন চিকিৎসক থেকে নার্সিংহোমের মালিকদের একাংশও। তাঁদের অভিযোগ, শুধু নার্সিংহোম নয়, দালাল-রাজের রমরমা রয়েছে খোদ বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালেও। আর তাই সেই হাসপাতালের গায়েও ফলাও করে আঁটা পোস্টার। লেখা, ‘দালাল থেকে সাবধান’! বর্ধমান শহরের বেশ কিছু নার্সিংহোমে গিয়েও দেখা গেল, ‘রোগীর পরিবারের উদ্দেশে’ টাঙানো ফ্লেক্স। সেখানে লেখা, ‘অ্যাম্বুল্যান্স চালকদের কথায় কোনও সিদ্ধান্ত নেবেন না ও রোগী ভর্তিও করবেন না।’

এমন ‘সাবধানবাণী’ কেন? নার্সিংহোম মালিকদের একাংশের দাবি, বছরখানেক আগে রোগী ভর্তি নিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স চালকদের ‘দাপট’ সামনে আসে। ওই সব অ্যাম্বুল্যান্স চালকদের সঙ্গে কিছু নার্সিংহোম মালিকদের ‘যোগসাজস’ প্রকাশ্যে আসতেই প্রশাসন ও স্বাস্থ্য দফতরের কড়া পদক্ষেপের মুখে পড়তে হয় শহরের প্রায় ৫০টি নার্সিংহোমকে। এমন ‘পরিস্থিতি’ ফের যাতে না হয়, তার জন্যই এমন ‘সাবধানবাণী’।

নার্সিংহোমের সঙ্গে যুক্ত একাধিক কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ফি বছর একের পর এক নার্সিংহোম তৈরির জন্যই তৈরি হয়েছে ‘অস্বাস্থ্যকর’ প্রতিযোগিতা। আর তাই দালালদেরও রমরমা। অভিযোগ, এক একটি নার্সিংহোমকে কেন্দ্র করে অন্তত একশো থেকে দেড়শো জন দালাল থাকে।

এই দালালদের কেউ নার্সিংহোমের পাশে চায়ের গুমটি চালান, কেউ বা ওষুধের দোকানের কর্মচারী, কেউ আবার আয়া, টোটো চালক।

কী ভাবে পাতা হয় রোগী ধরার ‘ফাঁদ’? ওই সব ‘পেশা’র সঙ্গে যুক্ত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চিকিৎসকের কাছে নাম লেখানো থেকে ওষুধের দোকান পর্যন্ত নানা ভাবে সাহায্য করেন চায়ের দোকানি। নার্সিংহোমে ভর্তির কথা জানতে পারলেই কোথায় কী চিকিৎসা হয়, সে বিষয়ে বিশদ-ব্যাখ্যা দিয়ে রোগীকে পরিচিত নার্সিংহোমে নিয়ে যান তিনি। এ ক্ষেত্রে নার্সিংহোমের বিলের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কমিশন পান চায়ের দোকানের মালিকেরা। আবার টোটো চালকরা রাস্তাতেই নানা ভাবে রোগীর পরিজনদের বুঝিয়ে নার্সিংহোমে নিয়ে গেলেই মেলে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত কমিশন। এক নার্সিংহোম মালিক বলছিলেন, “চায়ের গুমটির দোকানের মালিক দু’বছরের মধ্যে বর্ধমান শহরের মধ্যে জায়গা কিনে মার্বেল লাগানো দোতলা বাড়ি তৈরি করে ফেলছে। তা হলেই বুঝুন তাঁরা দালালি করে কত টাকা আয় করেন।”— এ তো গেল খোসবাগানের খোশগল্প।

নবাবহাট-কেশবগঞ্জ চটিতে গজিয়ে ওঠা নার্সিংহোমগুলির কী হাল? প্রশ্ন করতেই নবাবহাটের এক নার্সিংহোম মালিকের জবাব, “অ্যাম্বুল্যান্স চালকের সঙ্গে যোগসাজস না-থাকলে নার্সিংহোম বন্ধ করে দিতে হবে।” এই সব নার্সিংহোমে বীরভূমের রামপুরহাট, হুগলির আরামবাগ ও পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ার রোগীদের নিয়ে আসেন অ্যাম্বুল্যান্স চালকেরা। তেমনই এক চালকের কথায়, “আমরা রোগীর শারীরিক ও আর্থিক অবস্থা গল্পছলে বুঝে নিই। তার পরে কোন নার্সিংহোমে গেলে ভাল চিকিৎসা মিলবে, তা জানাই। ওই নার্সিংহোমে গিয়ে আমাদের আত্মীয়েরা কী চিকিৎসা পরিষেবা পেয়েছিল, তার উদাহরণ দিয়ে থাকি।” কিন্তু অভিযোগ, এই সব নার্সিংহোমে আইসিসিইউ থেকে অত্যাধুনিক চিকিৎসার কথা লেখা থাকলেও বাস্তবে তা নেই। এমনকী বিকেল পাঁচটার পরে আরএমও পর্যন্ত থাকে না। নার্সিংহোম মালিকেরাই জানান, আরামবাগ-কাটোয়া-রামপুরহাটের রোগীর জন্য ন্যূনতম ১০ হাজার টাকা ‘কমিশন’ দিতে হয় অ্যাম্বুল্যান্স চালককে। এ ছাড়াও অন্যান্য ‘সুযোগ-সুবিধা’ পান তাঁরা।

নার্সিংহোম মালিক সমিতির এক কর্তা বলেন, “প্রশাসন এক দিন অভিযান চালিয়ে কয়েকজনকে ধরে থানায় নিয়ে গেলেই দালাল-রাজ অনেকটাই কমে যাবে।” আর স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা জানান, ঠগ বাছতে গিয়ে গাঁ টাই তো উজাড় হয়ে যাবে। তবুও তাঁরা অনেক চেষ্টা করে আগের চেয়ে কিছুটা উন্নতি ঘটাতে পেরেছেন।

অন্য বিষয়গুলি:

Nursing Homes Middleman
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE