Advertisement
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

শব টেনে সংসার চালিয়ে তিনিই লক্ষ্মী

বাড়ি বাড়ি মেয়ে-বউরা যেখানে লক্ষ্মীপুজোর প্রস্তুতিতে ব্যস্ত তখন ভ্যানে শোয়ানো শবদেহ টেনে বেড়ান তিনি। সংসারে লক্ষ্মী আনতে পুজো করার সামর্থ্য নেই, বরং তাঁর কাজেই লক্ষ্মীর মুখ দেখে সংসার।

ডলি দে। নিজস্ব চিত্র।

ডলি দে। নিজস্ব চিত্র।

সুচন্দ্রা দে
কাটোয়া শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৬ ০২:৫১
Share: Save:

বাড়ি বাড়ি মেয়ে-বউরা যেখানে লক্ষ্মীপুজোর প্রস্তুতিতে ব্যস্ত তখন ভ্যানে শোয়ানো শবদেহ টেনে বেড়ান তিনি। সংসারে লক্ষ্মী আনতে পুজো করার সামর্থ্য নেই, বরং তাঁর কাজেই লক্ষ্মীর মুখ দেখে সংসার।

কাটোয়ার চাউলপট্টির ভাড়াবাড়ির দু’কামরা ঘরে বছর বত্রিশ ধরে সংসার পেতে রয়েছেন ডলি দে। আছেন স্বামী ছেলে, বৌমা, নাতি, নাতনি। ডলিদেবীই জানান, একসময় খেয়ে না পেয়ে মরার দশা হয়েছিল। সেখান থেকে স্বামীর কাজে হাত লাগানো শুরু। তারপর পনেরো বছর কেটে গিয়েছে। এখন একাই শবদেহ বয়ে আনেন হাসপাতালের মর্গে। আত্মহত্যা হোক বা খুন, মৃতদেহ গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় মিলুক বা জলে, খবর পেলেই ভ্যান নিয়ে ছোটেন বছর আটচল্লিশের ডলিদেবী। পুলিশের তদন্তের পরে তাঁর কাজ শুরু

তবে শুরুতে কাজটা সহজ ছিল না। পুরনো দিনের কথা বলতে বলতে চোখ জলে ভরে যায় ডলিদেবীর। তিনি বলে চলেন, কোলে তখন বছর আটের মেয়ে মান্টি ও বছর বারোর ছেলে দিলীপ। নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর মতো অবস্থা সংসারের। স্বামী তাসা বাজাতেন। কিন্তু ওই টাকায় চার জনের সংসার চলত না। দিনের পর দিন এক বেলা খেয়ে কাটাতে হয়েছে তাঁদের। জামা-কাপড়ও জোগাতেন চেয়েচিন্তে। এরপরেই অন্য পেশার কথা ভাবেন তাঁরা। ডলিদেবী বলেন, ‘‘স্থানীয় এক চিকিৎসকের পরামর্শে স্বামীর সঙ্গে কাজ শুরু করি। প্রথমে খুবই অস্বস্তি হতো। পরে অভ্যস্ত হয়ে যাই।’’ মৃতদেহ তুলে আনার কাজ করে মহকুমাশাসকের দফতর থেকে মাসে হাজার দুয়েক আয় হয় তাঁর। সেই টাকাই একটু একটু করে লক্ষ্মীর ভাঁড়ে জমান নাতি, নাতনিদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। ডলিদেবীর কথায়, ‘‘ছেলে সামান্য চালের গোডাউনে ঠিকা শ্রমিকের কাজ করে। নাতি, নাতনিদের পড়ানোর টাকা জোটাতে পারে না। আমিই সেই দায়িত্ব নিয়েছি।’’

কাজের জন্য তাঁকে দেখলে সরে যান অনেক পড়শি। না ছোঁয়া, সব জায়গায় ঢোকারও নিদান দেন অনেকে। তবে সে সবে কান দেন না ডলিদেবী। তাঁর সাফ জবাব, ‘‘প্রতিবেশীরাই নন, আত্মীয়রাও প্রথম প্রথম বারণ করত এই কাজ করতে। মা-বাবাও ত্যাগ করেছিলেন। তবে এখন সবাই মেনে নিয়েছে।’’

শুক্রবার ডলিদেবীর বাড়ি গিয়ে দেখা গেল পুজোর ফল, মিষ্টি কিনে তা গোছাতে ব্যস্ত তিনি। জানালেন, বাড়িতে পুজোর আয়োজন করার মতো সামর্থ্য নেই। তাই আত্মীয়ের বাড়িতেই লক্ষ্মীপুজোর অঞ্জলি দিতে যাবেন তিনি। কী চাইবেন দেবীর কাছে? অকপট জবাব, ‘‘ছেলেমেয়েদের যেমন মানুষ করেছি তেমন নাতি, নাতনিগুলোকেও যেন পড়াতে পারি।’’ পাশ থেকে স্বামী সেন্টু দে বলেন, ‘‘বরাবর আমার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করেছে। কটূক্তি শুনেও সংসারের জোয়াল টেনেছে নিজের হাতে। লক্ষ্মীপুজোর কি দরকার! স্ত্রীই আমার সংসারে লক্ষ্মী।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dolly De
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE