বর্ধমান রাজ কলেজিয়েট স্কুলের জীর্ণ ভবন। নিজস্ব চিত্র।
মোটা থামের লম্বা দালান। দেওয়াল চুঁইয়ে বৃষ্টির জল পড়ার দাগ স্পষ্ট। কোথাও কড়ি-বর্গা খসে পড়ছে, কোথাও ছাদ থেকে চাঙড় ভেঙে পড়েছে। পড়াশোনার ফাঁকে ছাত্র-শিক্ষকেরা ভবনের ছাদ, দেওয়ালের দিকে নজর রাখেন। পাঁচ বছর আগে ‘ঐতিহ্যবাহী’ স্কুলের ভবন বাঁচানোর দাবিতে পথে নেমেছিলেন বর্ধমান রাজ কলেজিয়েট স্কুলের পড়ুয়া থেকে শিক্ষকেরা। কিন্তু হাল ফেরেনি রাজ্যের অন্যতম পুরনো এই স্কুলের ভবনের।
পুজোর পরে স্কুল খুলতে পারে, বার্তা দিয়েছে রাজ্য সরকার। প্রায় দেড় বছর পরে স্কুল চালু হলে ‘ভাঙা ঘরে’ কী ভাবে পঠনপাঠন হবে, চিন্তায় পড়েছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। জেলা প্রশাসনের দ্বারস্থও হয়েছেন তাঁরা। পূর্ব বর্ধমানের জেলাশাসক প্রিয়ঙ্কা সিংলার আশ্বাস, ‘‘খুব গুরুত্ব দিয়ে স্কুলের বিষয়টি দেখা হবে। স্কুল শিক্ষা দফতরের সঙ্গে কথা বলব।’’
স্কুল সূত্রে জানা যায়, ১৮১৭ সালের ৬ জানুয়ারি বর্ধমানের রাজবাড়িতে স্কুলটি শুরু হয়। পরে, রানির বাড়িতে উঠে আসে সেটি। সেখান থেকে ১৮৮২ সালে স্কুলটি নতুনগঞ্জে উঠে আসে। ১৬ হাজার বর্গফুটের স্কুল ভবনের ঘরগুলির উচ্চতা ২৫ ফুট। ১৯১০ সালের ‘বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার’-এ বর্ধমানের তৎকালীন জেলাশাসক জেসিকে পিটারসন জানান, প্রথম দিকে স্কুলটির নাম ছিল ‘অ্যাংলো ভার্নাকুলার স্কুল’। বর্ধমান রাজ পরিবারের গবেষক, সদ্য প্রয়াত নীরোদবরণ সরকার জানিয়েছিলেন, কলকাতায় হিন্দু স্কুল তৈরির সময়ে মোটা টাকা দিয়ে বর্ধমানের রাজারা সাহায্য করেছিলেন। তার পরেই বর্ধমানের স্কুল গড়ার ক্ষেত্রে নজর দেয় রাজ পরিবার।
স্কুলের কর্তাদের দাবি, ১৮৩৩ সালে তৎকালীন স্কুল পরিদর্শক বাংলা, বিহার ও ওড়িশার বিভিন্ন স্কুল পরিদর্শন করে তৈরি করা এক রিপোর্টে বর্ধমান রাজ কলেজিয়েট স্কুলকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বলে জানিয়েছিলেন। এই স্কুলের পড়ুয়া ছিলেন স্যর রাসবিহারী ঘোষ, বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্ত, যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আচার্য যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, অভিনেতা কমল মিত্র প্রমুখ। স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুব্রত মিশ্রের দাবি, ‘‘এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন রামতনু লাহিড়ি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কত বার এসেছেন, ঠিক নেই। এমন ঐতিহ্যবাহী স্কুল ভবন রক্ষা করা, তার সঙ্গে স্কুলের নতুন ভবন গড়ে তোলার দাবি আমরা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে জানিয়েছি।’’
স্কুল সূত্রে জানা যায়, এই ভবটিকে জেলার বাস্তুকারেরা ১৯৮২ সালে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন। ২০০৭ সালে ভবনটি ‘হেরিটেজ’ তকমা দেয় রাজ্য হেরিটেজ কমিশন। ২০০৯ সালে পূর্ত দফতরের (সামাজিক ক্ষেত্র) ইঞ্জিনিয়ারের দফতর ভবনটি ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানায় ও খালি করার পরামর্শ দেয়। তার পরেও ১৯টি ঘরের মধ্যে ১৪টি ঘর ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে দাবি স্কুল কর্তৃপক্ষের। তাঁরা জানান, কয়েক বছর আগেও স্কুলে প্রায় ১,৬০০ পড়ুয়া ছিল। ভবনের অবস্থা দেখে এখন তা সাতশোয় নেমে এসেছে।
স্কুলের ভবন সংস্কার, নতুন ভবন গড়ার দাবি নিয়ে পূর্ত দফতরকে দিয়ে একটি ‘এস্টিমেট’ তৈরি করে কর্তৃপক্ষ। জেলা প্রশাসনের কাছে প্রথমে পাঁচ কোটি, পরে, সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতরের কাছে তিন কোটি টাকা দাবি করে চিঠি পাঠান স্কুল কর্তৃপক্ষ। প্রধান শিক্ষকের দাবি, ‘‘দু’বছর কেটে গেলেও কোনও টাকা পাইনি। হেরিটেজ কমিশনে গিয়েছিলাম। তারাও সাহায্য করতে অপারগ বলে জানিয়েছেন। সম্প্রতি জেলাশাসকের দফতরে গিয়েছিলাম। সেখানেও কোনও আশ্বাস পাইনি।’’ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘স্কুল খোলার পরে এত ছেলের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ করার কোনও অধিকার কি আমাদের আছে?’’ বর্ধমান হেরিটেজ অ্যাসোসিয়েশনের কর্তা সর্বজিৎ যশ ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রহশালার প্রাক্তন অধ্যক্ষ রঙ্গন জানাও বলেন, ‘‘আমরাও রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে চেষ্টা করেছিলাম।’’
জেলা সর্বশিক্ষা অভিযান সূত্রে জানা যায়, পাঁচ কোটি টাকার প্রকল্পটি স্কুল শিক্ষা দফতরে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু অনুমোদন আসেনি। জেলা স্কুল পরিদর্শক বা ডিআই (মাধ্যমিক) শ্রীধর প্রামাণিক জানান, জেলা প্রশাসন বিষয়টি দেখছে। জেলা প্রশাসনের দাবি, পদ্ধতিগত ভুলের কারণেই সম্ভবত অনুমোদন আসেনি।
স্কুলের এক শিক্ষক বলেন, ‘‘এই বুঝি ছাদটা ভেঙে পড়ল, এমন আতঙ্ক নিয়েই ক্লাস চালিয়ে যেতে হবে কি না, জানি না!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy