Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

বহুতল উঠছেই, প্রশ্ন পুর-পরিষেবা নিয়ে

আড়ে-বহরে বেশ খানিকটা বাড়ার পরে শহর এখন আকাশমুখী। শহরের বাইরের দিকে উপনগরী গড়ে উঠেছে আগেই। এ বার শহরের ভিতরেও উপনগরী গড়ার কাজ চলছে। তাছাড়া পুরনো বাড়ি ভেঙেও গড়ে উঠছে বহুতল।

পুরনো কার্জন গেট।

পুরনো কার্জন গেট।

সৌমেন দত্ত
বর্ধমান শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৫ ০১:০১
Share: Save:

আড়ে-বহরে বেশ খানিকটা বাড়ার পরে শহর এখন আকাশমুখী।

শহরের বাইরের দিকে উপনগরী গড়ে উঠেছে আগেই। এ বার শহরের ভিতরেও উপনগরী গড়ার কাজ চলছে। তাছাড়া পুরনো বাড়ি ভেঙেও গড়ে উঠছে বহুতল। কিন্তু লোকসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন উঠছে, যে আধুনিক জীবন চেয়ে বহুতলে বাসা বাঁধছেন মানুষ, সেই সমস্ত পরিষেবা মিলবে তো? পুরসভা আশ্বাস দিলেও সন্দেহ যাচ্ছে না শহরবাসীর।

দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি হওয়ার পরে বর্ধমান উন্নয়ন সংস্থার হাত ধরে শহরের দুই প্রান্তে গড়ে ওঠে ‘উল্লাস’ ও ‘রেনেসাঁ’ উপনগরী। এ ছাড়া শহরের ভিতর আরও দু’টি উপনগরী তৈরির কাজ চলছে। পাল্লা দিয়ে তৈরি হচ্ছে বহুতলও। জায়গা কিনে বহুতল গড়ার ঝোঁক যেমন রয়েছে, তেমনি পুরনো বাড়ি ভেঙেও বহুতল গড়ার প্রবণতা বাড়ছে। কিছুদিন আগে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত একটি বাড়ি ভেঙেও বহুতল গড়েছেন ওই পরিবারের সদস্যরা। শহরের হেরিটেজ কমিটির এক সদস্য বলেন, “যে সব বাড়ি ভেঙে বহুতল গড়ে উঠছে তার মালিকদের বাড়ির ঐতিহ্যের কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আবেদন জানালে, তাঁরা সাফ জানিয়েদিচ্ছেন, ফাঁকা বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। তাই বহুতল গড়ার জন্য প্রোমোটারদের দিয়ে দিচ্ছেন।”


উল্লাস এলাকায় উঠছে নিত্য নতুন আবাসন।

নবাবহাটের কাছে ‘রেনেসাঁ’ উপনগরীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেও জানা যায়, বাংলো, প্লট বা বহুতল বাড়ি বিক্রির হার বেশ ভাল। ‘উল্লাস’ উপনগরীর কর্মীরাও জানান, প্রথম দিকে এখানে বসবাস করার বিশেষ ছিল না, কিন্তু এখান বাসস্ট্যান্ড হয়ে কলকাতা, দুর্গাপুর কিংবা শহরের অভ্যন্তরের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ায় ‘উল্লাসে’ বসবাস করার প্রবণতাও বাড়ছে। নতুন নতুন বহুতলও গড়ে উঠছে ওই উপনগরীগুলিতে। জানা গিয়েছে, ওই উপনগরীগুলিতে বহুতল বাড়ি গড়ে ১৭ লক্ষ থেকে ২০ লক্ষ টাকায় মিলছে। আর বাংলোর দাম শুরু হচ্ছে ৪০ লক্ষ টাকা থেকে। এ ছাড়াও প্লট করে জমি বিক্রি করা হচ্ছে, যার দাম ১৩-১৫ লক্ষ টাকা।

শহরের ভেতরের অবস্থাটাও কমবেশি একই। ইতিহাসবিদেরা বর্ধমান শহরকে দু’ভাগে ভাগ করছেন। একটি হল, দামোদরের ধারে কাঞ্চননগর ও তৎসংলগ্ন এলাকা। আর অন্যটি স্টেশন ও পুরনো জিটি রোড বরাবর এলাকা। কাঞ্চননগর এলাকায় কীর্তিচাঁদ পর্যন্ত বর্ধমান রাজপরিবারের সদস্যরা থাকতেন। পরবর্তীতে ১৮৫৪ সালে রাজপরিবারের সদস্যরা উঠে আসেন নতুন বাড়িতে। আর পুরনো জিটি রোড বরাবর এলাকাতেই একসময়ে গড়ে উঠেছিল একের পর এক নীলকুঠি। থাকতের ইংরেজরা। দুই এলাকার মেলবন্ধন ঘটাতে খাল বুজিয়ে রাস্তা তৈরি করেছিলেন বর্ধমানের রাজারা। সেই রাস্তাই এখন বিসি রোড। এর উপরেই রয়েছে কার্জন গেট। বর্ধমানের ইতিহাস অনুসন্ধানী সর্বজিৎ যশ বলেন, ‘শুনেছি ১৯৪৮ সালেও বিসি রোডে মাত্র ৮টি দোতলা বাড়ি ছিল। পরে ১৯৯০ সালের পর শহরের লোকসংখ্যা বাড়তে থাকে। এখন তো শহরটাই আড়ে-বহরে বাড়ছে।’’ বিগত বাম বোর্ডের পুরপ্রধান আইনুল হকও বলেন, “ন’য়ের দশকে প্রায় এক লক্ষ লোকসংখ্যা বেড়ে যায় বর্ধমান শহরে। রেল সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন আড়াই লক্ষ লোক শহরে ঢুকছে। তখনই আমরা খড়গপুরের আইআইটিকে দিয়ে ‘ভিশন ২৫’ পরিকল্পনা করি। সেইমতো শহরের দু’প্রান্তে বাসস্ট্যান্ড তৈরি করা হয়।” আর এখন তো শহরের ভিতরে মাল্টিপ্লেক্স, শপিং মল থেকে শুরু করে আধুনিক জীবনযাত্রার প্রায় সমস্ত পরিকাঠামো গড়ে উঠছে। শহরের একটি নামী বিপণির কাছের বহুতলে ফ্ল্যাট শুরু হচ্ছে ৫৬ লাখ টাকা থেকে।

এ ছাড়াও শহরের বাদামতলা, বুড়িরবাগান, নীলপুর এলাকা, পুলিশ লাইন, গোলাপবাগ, লক্ষ্মীপুর, ভাঙাকুঠি, বাবুরবাগ তো বটেই শহর লাগোয়া পঞ্চায়েত এলাকাতেও একের পর এক গড়ে উঠছে বহুতল। দালাল ও প্রোমোটার সংস্থার সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, এলাকা ও সুবিধা অনুযায়ী বহুতলের দাম নির্ধারণ হয়। বুড়িরবাগান-জেলখানা মোড়ে বহুতল বিক্রি হচ্ছে যেমন ৫৫০০-৬০০০ টাকা বর্গফুটে, তেমনি নীলপুর-ইছালাবাদ-পুলিশ লাইন-কালনা গেট এলাকায় বহুতলের মূল্য ২৫০০-৩০০০ টাকা বর্গফুট। বর্ধমানের বড়বাজারের বাসিন্দা সিদ্ধার্থ কোনার, বাদামতলার অমিতাভ ঘোষ, বাজেপ্রতাপপুরের তনয় রায়চৌধুরীরা বলেন, “শহরের ভিতরে জায়গা নেই। যে জায়গা পড়ে রয়েছে তার দামের ঠিক নেই। এই অবস্থায় বাইরের বাসিন্দাদের কাছে বহুতল ছাড়া উপায় কোথায়। চাহিদা রয়েছে বলেই তো শহর ছাড়িয়ে পঞ্চায়েত এলাকাতেও বহুতলের প্রবণতা বাড়ছে।” শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে কামনাড়াতেও একটি আবাসন সংস্থার সঙ্গে যৌথ ভাবে উপনগরী গড়ে তুলছে বর্ধমান উন্নয়ন সংস্থা। বাড়ছে বাড়ি ভাড়াও। পুরনো বাড়ির ভাড়া ৫০০০ থেকে ৭০০০ টাকা পর্যন্ত ঘোরাফেরা করছে। আর বহুতলে ভাড়া নিতে গেলে বাজেট কমপক্ষে ৮ থেকে ১২ হাজার টাকা।

তবে বহুতল বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুর পরিষেবা মিলছে না বলে অভিযোগ এলাকার বাসিন্দাদের। শহরবাসীর দাবি, এমনিতেই বর্ধমান শহর জঞ্জালময়। লোক বাড়ায় আরও নোংরা বাড়ছে। এ ছাড়া নিয়ম বহির্ভূত ভাবে প্রতিটি বহুতলই সাবমার্সিবল পাম্পের মাধ্যমে যথেচ্ছ জল তুলছে, ফলে শহরে জল সঙ্কট দেখা দেবে বলেও এলাকার মানুষজনের মত। পুরসভার কাছে দ্রুত জল তোলার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করারও দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। এ ছাড়াও বহুতল তৈরির জন্য দমকলের নিয়ম মেনে দুটি সিঁড়ি বা দুটি লিফট থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু অধিকাংশ বহুতল এই নিয়ম মেনে গড়ে ওঠেনি। পুরসভা অবশ্য জানিয়েছে, তাঁরা বহুতল তৈরির অনুমতি দেওয়ার সময় নকশা ঠিক আছে কি না তা ভাল করে দেখে নেন। কিন্তু নকশা ঠিক থাকলেও তা বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না, তা দেখা হয় কী? উত্তর নেই পুরসভার কাছে।

ছবি: উদিত সিংহ।

(শেষ)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE