বর্ধমান রাজবাড়ি।
শহরের নাড়ির কথা লেখা থাকে তার ইতিহাসে। ইট-কাঠের পরতে-পরতে জড়িয়ে থাকা সেই সব গল্পই বলে দেয়, কেমন এই শহরের ঐতিহ্য, কী-ই বা তার সংস্কৃতি?
কষ্টের হলেও সত্যি, বর্ধমান শহর ঢুঁড়ে ইতিহাসের সেই পদচিহ্ন খুঁজে পাওয়া ভার। প্রধানত যে সব স্থাপত্যে ইতিকথার বাস, সেগুলির যত্নআত্তি বলতে কিছু নেই। বর্ধমান শহরের নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্থাপত্য কীর্তির অনেকগুলিরই জীর্ণ দশা। বহু ছবি, স্মারক পড়ে নষ্ট হচ্ছে।
যেমন, রাধারানি অধিরানি বালিকা বিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে পড়ে নষ্ট হচ্ছে বর্ধমানের এক রানির ছবি। সে রানির পরিচয় কী, তা জানার জন্যেও শহরের ইতিহাস অনুসন্ধিৎসুরা বিশেষ তৎপর নন। মানিকচাঁদের বসতবাটি, তাঁর প্রতিষ্ঠিত মন্দিরও দেখভালের অভাবে ভেঙে পড়ছে। দেওয়াল থেকে খসে পড়ছে চাঙর। অথচ তা রক্ষায় শহরের কেউ এগিয়েছে বলে খোঁজ মেলেনি। বাম আমলে শহরের প্রাচীন স্থাপত্যের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছিল। ভ্রমণকারীদের সাহায্যের জন্য খোলা হয়েছিল কাউন্টারও। শহরে বছর বছর হওয়া বর্ধমান উৎসবের মূল লক্ষ্যও ছিল শহরের ইতিহাসকে তুলে ধরে পর্যটনের গুরুত্ব বাড়ানো।
কিন্তু কিছুই হয়নি। শুধু তো স্থাপত্য নয়। একটা শহরের চলার বৃত্তান্ত লুকিয়ে থাকে লোকমুখে চলে আসা নানা গল্পকথা, গুজব, কিংবদন্তীতে। এ শহরেরও অলিতে-গলিতে তেমন কত রোমহর্ষক গল্প ছাড়ানো। কিন্তু স্থাপত্য সংরক্ষণের চেষ্টা যেমন নেই, সেই সব কাহিনি একত্রিত করে ইতিহাসের অজানা ফাঁকফোকর ভরাট করার নিষ্ঠ প্রচেষ্টাও তেমন হয়নি।
কী রকম সেই সব গল্পকথা?
শুরুটা তো শহরের নাম নিয়েই। কল্পসূত্র অনুযায়ী, জৈনদের ২৪তম তীর্থঙ্কর মহাবীর বা বর্ধমান স্বামী বর্ধমানের অষ্টিকাগ্রামে বেশ কিছুদিন ছিলেন। তাঁর নামেই না কি এ জনপদের নাম হয় বর্ধমান। তারপর মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের রাজত্বকালেও এ শহরের নাম মেলে (বধ-ই-দিওয়ান)।
দার-উল-বাহার (বাঁ দিকে), ও সর্বমঙ্গলা মন্দির (ডান দিক)।
এ সবেরই টুকিটাকি খোঁজ মেলে ইতিহাসের বইয়ে। কিন্তু যা মেলে না তা হল প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বৃত্তাকারে বয়ে চলা কথা-কাহিনি। যার মধ্যে যেমন ঠাঁই খুঁজে নেয় প্রবাদপ্রতিম মানুষের গল্প, তেমনি শহরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা স্থাপত্য, ঐতিহাসিক নিদর্শনের ইতিবৃত্ত। চলতে চলতে একসময় ইতিহাসকে বোধহয় ছাপিয়েও যায় জনশ্রুতি।
বর্ধমান শহরের অন্যতম প্রাচীন মন্দির দেবী সর্বমঙ্গলার। রাজা না হয়েও রাজা বলে খ্যাত কীর্তিচন্দের (১৭০২-৪০ খ্রীষ্টাব্দ) আমলে এ মন্দির তৈরি হয়েছিল। আজও প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে হাজারো মানুষ ভিড় করেন এ শহরে। শোনা যায়, মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত অষ্টাদশভুজা দেবীমূর্তির পদতলে কিছু একটা লেখা রয়েছে। সে নাকি এমন ভাষা যার পাঠোদ্ধার করা সুকুমার সেনের পক্ষেও সম্ভব হয়নি। জনশ্রুতি রয়েছে, শহরের এক পুকুরের পাঁকে নিমজ্জিত ছিলেন দেবী। তাঁর পিঠে নিত্য গেঁড়ি-গুগলি ভাঙত বাগদী সম্প্রদায়ের মানুষজন। এক দিন দেবী তৎকালীন বর্ধমানের রাজাকে স্বপ্নে বললেন, ‘তোর রাজত্বে এ ভাবে পড়ে থাকতে হবে আমায়? শীঘ্র আমাকে উদ্ধার করে মন্দির প্রতিষ্ঠা কর।’ রাজা ছুটলেন পুকুরের খোঁজে। কিন্তু দেবী নাকি বর্ধমানের রায়না থানার বেগুট গ্রামের কয়েকজন ব্রাহ্মণকেও একই আদেশ দেন। সেটা আবার রাজার স্বপ্নাদেশ পাওয়ার আগেই। লোকলস্কর জুটিয়ে রাজা বের হতে হতে ব্রাহ্মণেরা পুকুর থেকে মূর্তি তুলে বেগুটের দিকে ধা।ঁ রাজাও ছুটলেন। প্রস্তাব দিলেন, ‘আমি বরং মন্দির প্রতিষ্ঠা করি, আপনারা পূজা করুন।’ সেই থেকে বেগুট-নিবাসী ব্রাহ্মণদের বংশের ব্রাহ্মণেরাই এ মন্দিরে পুজো করেন।
এই কীর্তিচন্দ রাইয়ের আমলেই বর্ধমানের কাঞ্চননগরে স্থাপিত হয়েছিল বারোদুয়ারি। রাজার যুদ্ধজয়ের স্মারক সেটি। কথিত যে, মেদিনীপুরের চিতুয়া-বরোদার সামন্ত শোভা সিংহ, পাঠানদের সঙ্গে জুটে মুঘলদের অধিকারে থাকা বর্ধমান আক্রমণ করেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন বিষ্ণুপুরের রাজা, চন্দ্রকোনার তালুকদার প্রমুখও। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র যুদ্ধে নিহত হন। পতন ঘটে বর্ধমানের। শোভার সঙ্গে থাকা পাঠান সৈন্যের হাতে ধর্মভ্রষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় রাজবাড়িতে জহরব্রত করেন একাধিক রানি ও পুরবাসিনী। রাজকন্যা সত্যবতীকে কয়েদ করেন শোভা সিংহ। জোরাজুরি করাতে রাজকন্যার ছুরির আঘাতেই নিহত হন শোভা। সেই জয়ের স্মারক হিসেবেই পরবর্তীতে রাজা কীর্তিচন্দ ওই তোরণের নির্মাণ করান।
শহরের রাধারানি অধিকারি বালিকা বিদ্যালয়ের কাছাকাছি রয়েছে আরও একটি তোরণ। বারোদুয়ারির মতোই সে তোরণও বিজয়তোরণের চেয়ে প্রাচীন। নাম তার নূরজাহান গেট। ভারতসম্রাজ্ঞী হওয়ার আগে যাঁর নাম ছিল মেহেরুন্নিসা, যাঁর প্রথম স্বামী শের আফগান ছিলেন বর্ধমানের কর্তা। তিনি নিহত হওয়ার পরে জাহাঙ্গির এই বর্ধমান থেকেই নিয়ে গিয়ে নিকাহ্ করেছিলেন মেহেরকে। আজও রাজবাটির পাশে নিশ্চুপে বসে সেই শের আফগানের সমাধি। রাজার দেওয়ান মানিকচাঁদের প্রতিষ্ঠা করা এ তোরণ আবার দেওয়ানের প্রভুভক্তির কথা বলে। মানিকচাঁদ প্রথম জীবনে ছিলেন বর্ধমানের রাজা ত্রিলোকচন্দের কর্মচারি। সেখান থেকে যান নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে। পরে নিজের পরাক্রমে মুর্শিদাবাদ তথা বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁর দেওয়ান হন।
এ রকম কত সব কথা। যার কিছু ইতিহাসের পাতায় তোলা আছে, কিছু ঠাঁই পায়নি প্রামাণ্যতার অভাবে। কিন্তু অতীতের চিলেকোঠায় মাতা খুঁড়ে মরা সেই সব গল্প আজও গুছিয়ে তোলা গেল না কেন? কেনই বা অবহেলার আগাছায় ঢাকছে ঐতিহ্যের প্রাসাদ?
— উদিত সিংহ।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy