Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিজড়িত বাড়ি ভেঙে আবাসন, আক্ষেপ শহরে

বহু বছর আগে একবার এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এসেছিলেন সাহিত্যিক তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। পরবর্তীতে গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়েরও সামনাসামনি গান শুনেছিল শহরের বি বি ঘোষ রোডের এই বাড়ি। তবে আপাতত বিশাল আবাসন তৈরির জন্য ভেঙে ফেলা হচ্ছে প্রাচীন, স্মৃতি বিজড়িত ওই ভবনটি।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রাজা বিজয়চাঁদ। রয়েছেন দেবীপ্রসন্নবাবু।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রাজা বিজয়চাঁদ। রয়েছেন দেবীপ্রসন্নবাবু।

রানা সেনগুপ্ত
বর্ধমান শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০১৪ ০০:৫৬
Share: Save:

বহু বছর আগে একবার এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এসেছিলেন সাহিত্যিক তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। পরবর্তীতে গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়েরও সামনাসামনি গান শুনেছিল শহরের বি বি ঘোষ রোডের এই বাড়ি। তবে আপাতত বিশাল আবাসন তৈরির জন্য ভেঙে ফেলা হচ্ছে প্রাচীন, স্মৃতি বিজড়িত ওই ভবনটি।

শহরবাসীর প্রশ্ন, একমাত্র রবীন্দ্রস্মৃটিটুকু কী ধরে রাখা যেত না? পুরপ্রধান স্বরূপ দত্ত বলেন, “আমরা চাইলেই কী বাড়ির মালিক ওটা আমাদের হাতে তুলে দিতেন?”

শহরের বুক থেকে একে একে হারিয়ে গিয়েছে মনীষীদের স্মৃতিবিজড়িত ভবনগুলি। বিদ্যাসাগর, বঙ্গিমচন্দ্রের আনাগোনা ছিল এমন বাড়ির অস্তিত্ব আর নেই। ভাষাচার্য সুকুমার সেনের বসতবাটি ভেঙেও তৈরি হয়েছে গয়নার দোকান। মাস তিনেক পর থেকে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিজড়িত এই ভবনটিও আর থাকবে না।

বি বি ঘোষ রোডের ওই বাড়ির মালিক, তারাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের নাতি, সাহিত্যিক দেবপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের ছেলে, শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ি চন্দ্রচূড় মুখোপাধ্যায় অবশ্য আফশোষের সুরেই বলেন, “আমি যতদিন বেঁচে থাকব, বাড়িটি হয়তো ততদিন টিকে থাকবে। কিন্তু আমার পরে সাতভূতের আড্ডা হয়ে উঠবে এ বাড়ি।” চন্দ্রদূড়বাবুর দাবি, “কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটের রামমোহনের বাড়ির পাশ দিয়ে প্রায়ই যাতায়াত করি আমি। বাড়িটি জবরদখল হয়ে গিয়েছে। আমাদের রাঁচি শহরের একটা বাড়িরও সেই দশা। বাড়ির মালিকদেরই চোরের মত ঢুকতে হয়। তার উপর আমার তিন মেয়েই বিদেশে। এখানে কেউই আসবে না। বাধ্য হয়েই...”।

বর্তমানে ভবনটি।

কথা এগোতেই ওই বাড়ির ইতিহাস গড়গড় করে বলে যান চন্দ্রচূড়বাবু। ১৯৩৫ সালের ৩০ জুন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে এসেছিলেন। কবির আসার খবর চেপে গিয়েছিলেন বাড়ির মালিক, সাহিত্যিক দেবপ্রসন্ন। কিন্তু এ খবর কী চাপা দেওয়া যায়? নিমেষে খবর রটে গিয়েছিল শহরে। তারপরে বাড়ির বিশাল গেট উপচে মানুষ সেখানে ঢুকে পড়েছিলাম কবিদর্শনে। ছুটে এসেছিলেন শহরের বিশিষ্টেরা। বর্ধমানের মহারাজ বিজয়চন্দও। বাড়ির ডানদিকে দুটি বিশাল জানলার নিচে বসিয়ে কবির সঙ্গে ছবি তুলেছিলেন পরিবারের সদস্য ও গণ্যমান্যেরা। সে ছবি আজও ওই ভবনের বারান্দায় টাঙানো।

বর্ধমানের উপর দিয়ে শান্তিনিকেতনে যাতাযাতের সময় রবীন্দ্রনাথ এখানে নেমেই ট্রেন বদলাতেন। এক দিন সে সময়েই একটি ট্রাঙ্কের উপর ‘আর এন টেগোর’ লেখা দেখে ছুটে গিয়ে কবির সঙ্গে দেখা করেছিলেন ছাত্র সুকুমার সেন। তাঁর আত্মজীবনী ‘দিনের পরে দিন যে গেল’য় সে বিবরণ রয়েছে। কিন্তু বি বি ঘোষ রোডের ওই বাড়ি ছাড়া রবীন্দ্রনাথ বর্ধমান শহরের অন্য কোথাও, এমনকী রাজবাড়িতেও কখনও যাননি। শহরে আসার কয়েক বছর পরে রাজউদ্যোগে আয়োজিত বঙ্গীয় সাহিত্য সন্মেলনেও না। যেখানে তাঁর সভাপতিত্ব করার কথা ছিল। আজও ২৫ বৈশাখ, ২২ শ্রাবণ কবি কেন যাননি সে নিয়ে প্রশ্ন ওঠে শহরের বুকে।

চন্দ্রচূড়বাবু বলেন, “বাবার মুখে শুনেছি, খোদ বর্ধমানের মহারাজ কবিকে বলেছিলেন, ‘এই বাড়িতেই যদি এলেন, তাহলে একবার আমার প্রাসাদে চলুন।’ কবি বলেছিলেন, ‘আমি বর্ধমানের সবচেয়ে বড়লোকের বাড়িতে তো আসিনি। এসেছি এমন একজনের কাছে, যাঁর সঙ্গে আমার আত্মার যোগাযোগ রয়েছে’।”

কিন্তু পুরো বাড়ি না ভেঙে যে জানালাদুটির সামনে দাঁড়িয়ে কবির সঙ্গে ছবি তোলা হয়েছিল সেটুকুও কি সংরক্ষণ করা যেত না? শহরের ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে সেটাই নিদর্শন হয়ে থাকত। পুরপ্রধান স্বরূপ দত্ত বলেন, “আমরা ক্ষমতায় আসার আগেই ওই বাড়ি ভেঙে বিশাল আবাসন তৈরির প্ল্যান পাশ করে দিয়েছিল রাজ্য মিউনিসিপ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইরেক্টরেট। ফলে আমাদের পক্ষে তা ঠেকানো সম্ভব ছিল না। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ওই জমিতে আবাসন তৈরির প্লান পাশ করে দিতে হয়েছে আমাদের।” প্রাক্তন পুর চেয়ারম্যান আইনূল হক বলেন, “ওই ভবনে আবাসন তৈরির প্ল্যান তৃণমূলের পুরবোর্ডের আমলেই পাশ করা হয়েছে। তবে ওই প্ল্যান আইনত আটকানো যেত না। বাড়িটা হেরিটিজ বলে ঘোষিতই হয়নি।”

—নিজস্ব চিত্র।

অন্য বিষয়গুলি:

rabindranath tagore demolition new complex
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE