ফুরসত পেলে বসে পড়া শপিংমলেই। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।
দামোদরের এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে।
সময়ের ঢেউ সরতে-সরতে দুর্গাপুরের স্নায়ুকেন্দ্রটা কবে যেন ম্রিয়মাণ ইস্পাতনগরী ছেড়ে ঝকঝকে সিটি সেন্টারের দিকে সরে গিয়েছে। আর, টাউনশিপের মোড় ছেড়ে ফেসবুকের ওয়ালের দিকে সরে গিয়েছে আড্ডা।
কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানার কলোনি আর কিছু পুরনো গ্রাম দু’দশক আগেও দুর্গাপুর বলতে চোখে ভেসে উঠত এই ছবিটাই। নির্দিষ্ট সময়ে কারখানায় ‘ডিউটি’তে যেতেন কর্মীরা। ফিরতেনও নির্দিষ্ট সময়ে। যার যেমন শিফট, সেই মতো ডিউটিতে যাওয়ার আগে বা পরে আড্ডা দিতেন আড্ডাধারীরা। চায়ের দোকান, পাড়ার মোড়ের কালভার্ট, বাড়ির সামনের চাতাল বা খেলার মাঠ। গ্রীষ্মের বিকেল হোক বা শীতের দুপুর। পাড়ার ছেলেছোকরার দল হোক বা বাবা-কাকারা। নানা বৃত্তে আড্ডা জমত।
কত্তা যখন ডিউটিতে, ছেলেমেয়েরা ইস্কুলে, ফাঁক বুঝে আড্ডা দিয়ে নিতেন গৃহিণীরাও। উসখুস করতেন, কতক্ষণে ঘরের কাজ ফুরোবে। পাশের বাড়ির নতুন বৌ কেমন হল, কাকলিদির কাছে খবর নিতে হবে না! রান্নায় যিনি আনকোরা, তিনি আবার ভাবছেন উল্টোদিকের কোয়ার্টারের লতামাসির কাছে কখন সুক্তো রান্নার গোপন ফর্মুলাটা শিখে নেবেন।
এক ধাক্কায় ছবিটা পাল্টে গিয়েছে।
সেই সব রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার রমরমা আর আগের মতো নেই। অনেক কারখানা বন্ধই হয়ে গিয়েছে। তার জায়গা নিয়েছে বেসরকারি সংস্থা। আগের মতো বাঁধা সময়ের ‘ডিউটি’ নয়, বরং রাত-দিন এক করে পেশার সিঁড়ি চড়ার দৌড়ে অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছে আগের সেই ঢিমে তেতালার আলস্যমাখা পরিবেশ। কিন্তু আড্ডা যে পুরোপুরি উবে গিয়েছে, এমনটা বলা যাবে না মোটেও। বরং পাড়ার মোড় ছেড়ে কিছু আড্ডা গিয়ে সেঁধিয়েছে রাতারাতি গড়ে ওঠা শপিং মলে। কিছু আড্ডা ঢুকে পড়েছে শোবার ঘরে বিছানায় বিছোনো ল্যাপটপে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটেই সেখানে যাবতীয় বকবকম।
এই পাল্টে যাওয়াটা কেমন লাগছে দুর্গাপুরের?
বছর পঁয়ষট্টির ললিতা রায় এখন থাকেন সিটি সেন্টার এলাকায়। তাঁর মনে পড়ে সেই সব দিনগুলোর কথা, যখন গরমের সন্ধেবেলা বরের সঙ্গে বাড়ির সামনের কালভার্টে বসে গল্প করতেন। তাঁর কথায়, ‘বিয়ের পরেই আমি বাঁকুড়া থেকে দুর্গাপুরে চলে আসি। আমার স্বামী ডিএসপি-তে চাকরি করতেন। তাই আমরা ডিএসপি টাউনশিপে থাকতাম। গরমকালটা ছিল আমাদের কাছে সবচেয়ে ভাল সময়। সন্ধ্যে নামে অনেক দেরি করে। বিকেলে আশপাশের কোয়ার্টারের সবাই মিলে অনেকক্ষণ এক সঙ্গে কাটানো যেত।’’
ললিতাদেবীর সেই সব সঙ্গীরা বেশির ভাগই আজও দুর্গাপুরেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। দেখা হয় না আর। ললিতাদেবীর ছেলেও এখন ডিএসপি-তেই চাকরি করেন। হয়তো কাজে আসা-যাওয়ার পথে একটু-আধটু আড্ডা দিয়েও যান। কিন্তু তাঁর বৌমা আর তাঁর মতো করে পাড়ায় আড্ডা মারার জন্য হাঁসফাঁস করেন না। বরং তাঁর অনেকটা সময়ই কাটে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ‘ফ্রেন্ড’দের সঙ্গে গপ্পোগুজব করে।
সবে শীত পড়েছে। ছুটির দিনে ডিএসপি টাউনশিপের একটি পার্কে বাচ্চাদের নিয়ে এসেছেন বেশ কিছু গৃহিণী। তাঁদেরও মুখে একই কথা, “এখন তো ফেসবুকেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনেকের সঙ্গে আড্ডা মারা যায়। অন্য কোথাও যাওয়ার কী দরকার? আজ নেহাত রবিবার, তাই এখানে এসেছি।” অনেকের এমনকী এমনও অভিজ্ঞতা হয়েছে যে যখন সোশ্যাল সাইটে কোনও বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়, গল্পের তুবড়ি ছোটে। অথচ দৈবাত্ সত্যি যখন মুখোমুখি দেখা হয়ে গিয়েছে, কথা খুঁজে পাওয়া ভার।
সিটি সেন্টারের একটি শপিং মলের রেস্তোরাঁয় ৫০-৬০ বছরের মধ্যে কয়েক জন দম্পতি বসে চা খাচ্ছিলেন আর বেশ গলা চড়িয়েই গল্প করছিলেন। তাঁদেরই এক জন, কিংশুক মাইতির মনে পড়ে, “জীবনের শুরুতে আড্ডা ছিল চায়ের দোকানে। প্রত্যেক দিন সকালে সেখানে গিয়ে চা না খেলে যেমন সকাল শুরু হত না, তেমনই আড্ডা না দিলে দিন ভাল যেত না। আরে বাবা, আমরা তো অত কেরিয়ার কনশাস ছিলাম না!” বন্ধুরা সামনে নেই, খালি কম্পিউটারের পর্দায় কথা হচ্ছে, এই অদ্ভূত ব্যাপারটা তাঁরা বুঝেই উঠতে পারছেন না।
তবে সকলে যে নিলাভ পর্দায় আটকে আছেন, তা নয়। দুর্গাপুর সরকারি কলেজের পাশে একটি গাছের তলায় বসে ছিলেন জনা পনেরো তরুণ-তরুণী। রোজই তাঁদের এই আড্ডা জমে। তাঁদেরই এক জন, অনিল সুরের কথায়, “ছোটবেলায় মা-কাকিমাদের দেখেছি এক সঙ্গে বসে আড্ডা দিতে। বাবা-কাকারাও তো এত আড্ডা দিতেন, নাওয়া-খাওয়ার কথাও মাথা থাকত না। আমাদের শরীরে তো তাঁদেরই জিন, না কি” বলেই হেসে ফেলেন অনিল।
আর একটা আড্ডা দুর্গাপুরে আছে। সেই আসানসোল-দুর্গাপুর ডেভলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (আড্ডা)-কে কেউ ততটা সরস বলে মনে করেন না নিশ্চয়ই!
(শেষ)
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু
বলার থাকলে ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ।
subject-এ লিখুন ‘আমার শহর দুর্গাপুর’।
প্রতিক্রিয়া জানান www.facebook.com/anandabazar.abp
অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, বর্ধমান বিভাগ,
জেলা দফতর আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১ ঠিকানায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy