প্রবীণ তোগাড়িয়া
গত জানুয়ারি মাসেই বীরভূমের রামপুরহাটে সংগঠনের একটি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নেতা প্রবীণ তোগাড়িয়া। ওই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে সেই সময় রাজনীতিকদের মধ্যে নানা সমালোচনা হলেও তোগাড়িয়ার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করার কোনও চেষ্টা করেনি রাজ্য সরকার। কিন্তু তার মাস দুয়েকের মধ্যেই সেই ভিএইচপি নেতার আসন্ন সফর আটকাতে রাজ্য জুড়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করল নবান্ন। এবং সেটা ঘটনাচক্রে পুরভোটের মুখে।
আগামী ৩ এবং ৪ এপ্রিল কলকাতায় একটি কর্মিসভায় যোগ দেওয়ার কথা তোগাড়িয়ার। ৫ এপ্রিল রায়গঞ্জে সংগঠনের আরও একটি অনুষ্ঠান আছে। তার তিন দিন আগে, বুধবার রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় এক প্রেস বিবৃতি জারি করে জানালেন, প্রবীণ তোগাড়িয়ার এ রাজ্যে ঢোকা আটকাতে গত ৩১ মার্চ থেকে রাজ্য জুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। নির্দিষ্ট খবরের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট জেলাশাসক, পুলিশ সুপার ও কমিশনারেরা ওই ধারা জারি করেছেন। তাঁদের মনে হয়েছে, তোগাড়িয়া যদি জনসভা বা মিছিল করেন, এমনকী সংগঠনের কর্মীদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকও করেন, তা হলে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি হবে এবং তা জনজীবন অশান্ত করে তুলবে।
যাঁকে নিয়ে নবান্নের এই সিদ্ধান্ত সেই তোগাড়িয়া বলেছেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে আমার ঢোকা আটকাতে সমস্ত জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করে মমতা ভুল করলেন। যেখানে সুপ্রিম কোর্টও ইন্টারনেটের মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে রায় দিয়ে ৬৬এ ধারা বাতিল করেছে, সেখানে আমার উপরে কেন এই নিষেধাজ্ঞা?’’
নবান্নের শীর্ষমহল অবশ্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন, গত কিছু দিন ধরে রাজ্যের কোথাও ধর্মান্তরণ, কোথাও মিশনারি স্কুলে সন্ন্যাসিনীর উপরে হামলা, কোথাও বা আবার সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে পড়ে দুষ্কৃতীমূলক কাজকর্ম ঘটানোর মতো পরিস্থিতি তৈরির প্রবণতা বাড়ছে। এই ধরনের ঘটনা সংগঠিত করার ক্ষেত্রে যাঁদের ভূমিকা থাকতে পারে অথবা অতীত রেকর্ড আছে, কিংবা যাঁরা সম্প্রীতির পরিবেশ নষ্ট করতে চাইছেন, তাঁদের রাজ্যে ঢুকতে দেওয়া যায় না।
তৃণমূল সূত্রের বক্তব্য, পুরভোটের মুখে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে তাতে অশান্তির বাতাবরণ তৈরি হবে। সেটা রাজনৈতিক ভাবে সুখকর হবে না। তাই সরকারের এই পদক্ষেপ। বিরোধীদের অবশ্য বক্তব্য, তৃণমূলের এই ব্যাখ্যা অযৌক্তিক। তাঁদের দাবি, আসলে পুরভোটের আগে সংখ্যালঘু আবেগ নিজেদের দিকে আরও বেশি করে টানতেই এই সিদ্ধান্ত।
তোগাড়িয়াকে যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার পশ্চিমবঙ্গে ঢুকতে না দেয়, তা হলে সংগঠন আদালতের দ্বারস্থ হবে বলে দিল্লিতে জানিয়েছেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সর্বভারতীয় মুখপাত্র সুরেন্দ্র জৈন। তিনি বলেন, ‘‘পরিষদ আইনের বাইরে গিয়ে কোনও পদক্ষেপ করবে না। তোগাড়িয়া যাতে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকতে পারেন ও প্রকাশ্যে সভা করতে পারেনতার জন্য আদালতে যাব আমরা।’’ সুরেন্দ্রর বক্তব্য, অতীতেও অমিত শাহের সভা আটকে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। তখনও আদালতের দরজায় কড়া নাড়িয়েছিল বিজেপি। শেষ পর্যন্ত আদালতের নির্দেশে সেই সভা হয়েছিল।
তোগাড়িয়ার ক্ষেত্রেও সে পথেই হাঁটতে চলেছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। সংগঠনের পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা শচীন্দ্রনাথ সিংহ বুধবারবলেন, ‘‘রায়গঞ্জের মহকুমাশাসকই সেখানে সভা করার অনুমতি দিয়েছিলেন। ওই সরকারি নথি নিয়েই আজ, বৃহস্পতিবার আদালতে যাব আমরা।’’ এর পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ করবে নবান্ন।
তবে এর পরেও মমতা তাঁর সিদ্ধান্ত বদল করবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন ভিএইচপি নেতা বিনোদ বনশল। তিনি বলেছেন, ‘‘আশা করি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবেন।’’ যদিও আরএসএস-এর প্রধান মোহন ভাগবত এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। এ দিন তিনি কলকাতাতেই ছিলেন। তবে বিজেপি সাংসদ মুরলী মনোহর জোশী বলেছেন, ‘‘এই সিদ্ধান্ত ঠিক নয়।’’
রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ কোনও মন্তব্য করতে না চাইলেও রাজ্যে ওই দলের একমাত্র বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘‘পুরভোটের আগে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ব্যর্থ চেষ্টা করছে সরকার। এই ঘোষণায় কোনও সম্প্রদায়েরই খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের সঙ্কট মিটবে না।’’ আর এ রাজ্যের বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়র বক্তব্য, ‘‘কিছু সংখ্যালঘু নেতা মাঝেমধ্যেই দেশবিরোধী মন্তব্য করেন। তাঁরা এ রাজ্যে ঢুকলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার কী করে, সেটা দেখার অপেক্ষায় রইলাম।’’
বিরোধী সিপিএম এবং কংগ্রেস নেতারা অবশ্য মনে করেন, পুরভোটের আগে এ ধরনের সিদ্ধান্ত ‘রাজনৈতিক চমক’ ছাড়া কিছুই নয়। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘এর আগে প্রবীণ তোগাড়িয়া, মোহন ভাগবতরা রাজ্যে ঘুরে গিয়েছেন। তখন উনি কি করছিলেন? পুরভোটের আগে কি ওঁর ঘুম ভাঙল?’’ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানও মন্তব্য করেন, ‘‘এটা মমতার আর একটা নাটক। যখন যে রকম দরকার পড়ে, তখন উনি তা-ই করেন। এটা দ্বিচারিতা। লোকসভা ভোটের আগে উনি বলেছিলেন, নরেন্দ্র মোদীর কোমরে দড়ি পরাবেন। কিন্তু সিবিআই থেকে বাঁচতে সেই মোদীর কাছেই আত্মসমর্পণ করেছেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy