প্রাণঘাতী: মিলেছে এই অস্ত্র। ছবি: তাপস ঘোষ
দুষ্কৃতী দৌরাত্ম্যে দীর্ঘদিন ধরেই নাজেহাল হুগলি জেলার মানুষ। খুন-জখম, বোমাবাজি, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দাপাদাপি—কিছুই বাদ নেই। চন্দননগর কমিশনারেট গড়েও লাভ হয়নি বলে অভিযোগ ছিলই। এত আগ্নেয়াস্ত্র কোথা থেকে আসছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছিল। বৃহস্পতিবার রাতে চন্দননগরেরই সাবিনাড়ায় মিলল অস্ত্র কারখানার হদিস। রানিঘাটে আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহ করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ল তিন কারবারি। তাদের মধ্যে কারখানার মালিক-সহ দু’জন শহরেরই বাসিন্দা। মিলল আগ্নেয়াস্ত্র, অস্ত্র তৈরির সরঞ্জামও।
বছর দুয়েক আগে পাশের শহর ভদ্রেশ্বরের চাঁপদানিতেও অস্ত্র কারখানার হদিস মিলেছিল। শোরগোল ফেলা সেই ঘটনার পরে এ বার চন্দননগরে একটি অস্ত্র কারখানার হদিস মেলায় স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে কমিশনারেটের ভূমিকা নিয়ে।
পুলিশ জানিয়েছে, ধৃতেরা হল সাবিনাড়ার বাসিন্দা প্রণবেশ দে ওরফে বাপি, লিচুপট্টির বাপন মণ্ডল ওরফে রাজু এবং নৈহাটির শেখ নুরউদ্দিন। প্রণবেশই অস্ত্র কারখানার মালিক। বৃহস্পতিবার রাত ৮টা নাগাদ দু’টি সেভেন এমএম নিয়ে প্রণবেশ এবং বাপন রানিঘাটে দাঁড়িয়েছিল। নুরউদ্দিনের তা নিয়ে যাওরা কথা ছিল। নুরউদ্দিন লঞ্চে এসে ঘাটে নামতেই তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়। ধৃতদের জেরা করে অস্ত্র কারখানার হদিস মেলে। সেখান থেকে তিনটি পুরো তৈরি না-হওয়া সেভেন এমএম ও তার ২২০টি তাজা গুলি, এইট এমএমের ৭০টি তাজা গুলি এবং অস্ত্র তৈরির দু’টি ড্রিল মেশিন-সহ কিছু যন্ত্রপাতি বাজেয়াপ্ত করা হয়। ২০১৪ সালে অস্ত্র-সহ ধরা পড়ে প্রণবেশকে হাজতবাসও করতে হয়। বাকি দুই ধৃতের বিরুদ্ধে অবশ্য আগে কোনও অভিযোগ ওঠেনি।
তদন্তকারীদের দাবি, প্রণবেশ কবুল করেছে, মাস পাঁচেক ধরে সে কারখানা চালাচ্ছিল। বিহারের ছাপরা, মুঙ্গের এবং আরা থেকে সে অস্ত্র তৈরির কারিগর এনে কিছুদিন নিজের বাড়িতে রেখে কাজ করাত। তার পরে তাদের ফেরত পাঠিয়ে অন্য কারিগর আনত। জেলা-সহ নানা জায়গায় ওই আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহ করা হত।
পুলিশ কমিশনার অজয় কুমার বলেন, ‘‘আমাদের গোয়েন্দা দফতর অনেকদিন ধরেই নজরদারি চালাচ্ছিল। বৃহস্পতিবার রাতে অভিযান হয়। ওই কারবারের সঙ্গে ভিন্ রাজ্যের যোগ বা আরও কারা জড়িত তা খতিয়ে
দেখা হচ্ছে।’’
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, সাবিনাড়ার একদম শেষ প্রান্তে প্রণবেশদের বাড়ি। বছ বত্রিশের যুবকটি আগে টোটো চালাত। বাপনই তাকে অস্ত্র কারবারের প্রস্তাব দেয় বলে তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন। প্রণবেশ বাড়ির দোতলার একটি ঘরে অস্ত্র কারখানা বানায়। নিজে টোটো চালানো ছেড়ে দেয়। তার দু’টি টোটো অবশ্য এখন ভাড়ায় খাটে।
দোতলাতেই থাকেন প্রণবেশের স্ত্রীও। বাড়ির একতলায় প্রণবেশের বাবা পরিমল দে এবং মা রিনাদেবী থাকেন। কিন্তু তাঁরা কেউ-ই অস্ত্র কারখানা নিয়ে কিছু জানতেন না বলে দাবি করেছেন। পরিমলবাবু ক্যানসারে শয্যাশায়ী। রিনাদেবী বলেন, ‘‘কিছুই জানতাম না। রাতের দিকে ছেলের কাছে কয়েকজন আসত। তারা ছেলের ঘরেই কয়েকদিন থেকে চলে যেত। ওই ঘরে আমাদের যেতে দিত না। পুলিশ আসার পরে সব জানতে পারি।’’ এক পড়শি বলেন, ‘‘ছেলেটা আগে ভাল ছিল। টোটো চালানোর পর থেকেই বিপথে চলে যায়। ওর আচরণে ঔদ্ধত্য এসে গিয়েছিল। ওর জন্য এলাকায় অপরিচিত লোকের আনাগোনা বাড়ছিল। পাড়ার লোকজন ভয়ে কিছু বলত না।’’
কারখানা-ঘরটি পুলিশ ‘সিল’ করে দিয়েছে। কিন্তু পাঁচ মাস ধরে পুলিশ কী করছিল, সে প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। বিজেপির ওবিসি মোর্চার রাজ্য সভাপতি স্বপন পালের কটাক্ষ, ‘‘পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করবে কী করে? পুলিশের নজর এড়িয়ে কী করে ওই কারখানা চলছিল?’’ সিপিএমের জেলা সম্পাদক দেবব্রত ঘোষও বলেন, ‘‘কমিশনারেট হওয়ার পরে অপরাধ বেড়ে গিয়েছে। পুলিশ সামলাতে ব্যর্থ।’’
পুলিশ অবশ্য দাবি করেছে, ঘটনার কথা জানামাত্র অভিযান হয়। রাজ্যের মন্ত্রী তথা তৃণমূলের জেলা সভাপতি তপন দাশগুপ্তও বলেন, ‘‘মুঙ্গেরের সঙ্গে ঘটনার যোগ রয়েছে। ফলে, পুলিশ চক্রকে ধরে প্রশংসনীয় কাজই করেছে। জেলার আইনশৃঙ্খলা পুরোপুরি পুলিশের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। বিরোধীরা রাজনীতি করার জন্যই পুলিশের সমালোচনা করছেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy