ওখানেই ছিল আমার বাড়ি। গিলেছে আয়লা। দেখাচ্ছেন নিতাই দাস। নিজস্ব চিত্র
পড়ন্ত বিকেলে নদীর ধারে বইতে শুরু করল দমকা হাওয়া। বাঁধের উপরে আর দাঁড়িয়ে থাকতে সাহস পেলেন না বছর সত্তরের বৃদ্ধ। কাস্তে হাতে পড়িমরি ছুটলেন বাঁধ লাগোয়া খড়ের ছাউনির বাড়ির দিকে। যেতে যেতে বললেন, ‘‘দড়িগুলো কষে বাঁধতে হবে গো বাবু।’’
নামখানার নারায়ণপুরের হাতানিয়া দোয়ানিয়া নদীর পাড় ঘেঁষে খড়ের চালের মাটির ঘর ছিল নিতাই দাসের। ১০ বছর আগের আয়লা উড়িয়ে নিয়ে যায় সেই চাল। প্রবল বৃষ্টিতে ধসে যায় বাড়ি। নদীর পাড়ে পূর্বপুরুষের ভিটের ছিটেফোঁটা পড়ে রয়েছে ধ্বংসস্তূপ হয়ে। নিতাইবাবু সেটাই দেখাচ্ছিলেন। আওড়াচ্ছিলেন স্মৃতি। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় ফণীর দমকা হাওয়া তাঁর তাল কেটে দিল।
আয়লার পরে সেচ দফতরের তৈরি পাকা বাঁধ ঘেঁষা মাটির ঘরের ছাউনির দড়িতে টান দিতে দিতে বৃদ্ধ চোয়াল শক্ত করে বললেন, ‘‘আর কত ভাসাবে, ওড়াবে, জানি না।’’ নিতাইবাবুর মতো মনের জোর অবশ্য আজ আর নেই মঞ্জুরি মণ্ডলের। নারায়ণপুরের চতুর্থ ঘেরি বাঁধের পাশে তাঁরও ত্রিপলের ছাউনির ঘর। দমকা
হাওয়া যখন আসছে হাতানিয়া-দোয়ানিয়ার দিক থেকে, বাঁধের উপরে বসে এক মাথা ঘোমটা টেনে প্রৌঢ়া শোনাচ্ছিলেন ১০ বছর আগেকার সেই রাতের কথা: ‘‘হঠাৎ শোঁ শোঁ শব্দ। তার পরেই উড়ে গেল ঘরের চাল। নদীর জলের ধাক্কায় মাটির দেওয়াল ভেঙে গেল। হুহু করে ঢোকা জলে ভরে গেল ঘর।’’
চোখের কোণ ভিজে যাচ্ছে বারবার। আঁচলের খুট দিয়ে মুছে মঞ্জুরিদেবী জানালেন, রাতে বাড়ির ১২ জন মিলে উঠে এসেছিলেন বাড়ির পিছনের উঁচু জায়গায়। এখন সেখানে তৈরি হয়েছে বাঁধ। শ্বশুরের ১৫ কাঠা জমি আজ নদীর গর্ভে। বাঁশের ছাউনির ঘরের কঙ্কালটা আজও পড়ে রয়েছে নদীর পাড়ে। ফণীর আতঙ্কেও সেই ধ্বংসস্তূপ দেখেই শান্তি পান মঞ্জুরিদেবী। জানালেন, আয়লায় সব চলে যাওয়ার পরে নিতাইবাবুর দেওয়া কিছুটা জায়গাতেই ঘর বানিয়েছেন মীন ধরে পেট চালানো প্রৌঢ়া।
কিন্তু ফের বাঁধের পাশে বাড়ি কেন? ফণীতে যদি আবার ভেসে যায়?
‘‘এটা তো পাকা, উঁচু বাঁধ। ঘরের চাল উড়লেও জলের তোড়ে তো বাড়ি ভাঙবে না,’’ বললেন মঞ্জুরিদেবী, নিতাইবাবুরা। স্থানীয় অনেক বাসিন্দাই বাঁধ ঘেঁষে ঘর বানিয়ে ফেলেছেন।
তাই বাঁধ তৈরির জন্য ঠিকমতো জমি মেলেনি। সেই জন্য স্থায়ী বাঁধ সব জায়গায় সমান মাপের হয়নি। নারায়ণপুরের চতুর্থ ঘেরির প্রায় ৬৫০ মিটার লম্বা ওই বাঁধ তাই এক-এক জায়গায় এক-এক আকৃতির।
বাঁধ ব্যবহার করে বাসিন্দাদের একাংশের বিবিধ কাজকর্ম মাঝেমধ্যে বিপাকে ফেলে সেচকর্তাদেরও। যেমন শুক্রবার ফণী কাকদ্বীপে আছড়ে পড়ার আগেই মাটির বাঁধে ফাটল ধরেছে ত্রিলোকচন্দ্রপুরে। মুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ের মাটির বাঁধের নীচ দিয়ে বেআইনি ভাবে নালা কাটায় তাতে ‘ঘোগ’ (বড় গর্ত) তৈরি হয়েছিল। তাতেই ভেঙেছে বাঁধ। বাঁশ, মাটির বস্তা দিয়ে কোনও মতে ঠেকিয়েছে সেচ দফতর। কাকদ্বীপ ডিভিশনের কার্যনির্বাহী বাস্তুকার কল্যাণ দে বলেন, ‘‘অবিলম্বে ব্যবস্থা না-নিলে ফণীর তাণ্ডব তো মুড়িগঙ্গা নদীর বাঁধ ভেঙে গ্রাম ভাসিয়ে দিতে পারে।’’
আয়লার রাতে কোলের শিশুকে নিয়ে কোনও মতে ভেসে ভেসে ত্রাণশিবিরে যাওয়ার কথা আজ বারবার মনে পড়ছে রামতনুনগরের হাফিজা বিবির। নদীর পাড় ছেড়ে পাকা বাঁধের নীচে এখন ঘর বানিয়ে, সামনের ছোট জমিতে ফলিয়েছেন করলা, ঢেঁড়স। ফণীর ছোবলে সেই আনাজ রক্ষা পাবে কি না, চিন্তায় পড়েছেন হাফিজা। ক্ষোভও রয়েছে। বললেন, ‘‘নদী জমি নিল। বাঁধের জন্য সরকার জমি নিল। এক বিঘা জমি শেষ। টাকা পেলাম না আজও।’’
তবে তাঁর মতো আর ভাবতে চান না কাকদ্বীপের উত্তর চন্দ্রপুরের আয়ুব খান। স্ত্রী রুকবানু বিবিকে নিয়ে আয়লা বাঁধের উপরে উঠে ঠাহর করার চেষ্টা করছিলেন, হুগলি নদীতে জল কতটা বাড়ল। ভয় করছে? প্রশ্ন করতেই অসুস্থ আয়ুবের জবাব, ‘‘সব সয়ে গিয়েছে। আর ভয় নাই গো।’’
তবে গাঁয়ের লোককে নিরাপদে রাখতে চান আয়ুব। তাই সকালেই ছুটেছিলেন স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাবি খুঁজতে। রাতে তো সেখানে সকলের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। তিনিও তা হলে রাতে সেখানেই থাকবেন...।
কথা কেড়ে আয়ুবের উত্তর, ‘‘ভেসে ভেসেই তো জীবন কেটে গেল। দেখি, এ বারের টানে কোথায় নেয়!’’
ঝমঝমিয়ে নামা বৃষ্টির দাপটে তখন উত্তাল হয়ে উঠছে আয়ুব-রুকবানুর সামনের নদী...।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy