জোটের ভবিষ্যৎ, ভবিষ্যতের জোট। ছবি: সংগৃহীত।
সাগরদিঘিতে বাম-কংগ্রেস জোট জোর ঝটকা দিয়েছে বাংলার শাসকদল তৃণমূলকে। ত্রিপুরায় বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে না পারলেও বাম-কংগ্রেসের জোটের উপরে মানুষের আস্থা প্রকাশ পেয়েছে বলেই মনে করছেন দুই দলের নেতৃত্ব। এমন ফলের পর বাংলায় জোট রাজনীতির প্রবক্তারা ‘পালে হাওয়া’ পেয়েছেন বলেই মনে করা হচ্ছে। সেটা যে সত্যি, তা স্বীকার করে নিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও। জয়ের পথ মসৃণ হতেই তিনি বলেছেন, ‘‘সাগরদিঘির মানুষ এই জোটকে মান্যতা দিয়েছে। এ বার গোটা রাজ্যে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস জোটকে মানুষের কাছে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে। তা হলেই পঞ্চায়েত ভোটে সাফল্য আসবে। জোটবদ্ধ হলেই তৃণমূলকে হারানো সম্ভব।’’ জোট গড়ে তৃণমূলের পাশাপাশি বিজেপিকে মোকাবিলার কথাও বলেছেন তিনি।
সরাসরি জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু না বললেও সাগরদিঘির ফল যে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তা মানছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমও। তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূলকে যাঁরা সমর্থন করেছিলেন, তাঁরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন, কী সর্বনাশ হয়েছে রাজ্যের। প্রতি দিন চাকরির দুর্নীতির খবর। নগদে, সোনায়, সম্পত্তিতে কোটি কোটি টাকার কারবার, ক্রমাগত যা কালীঘাটের দিকে এগোচ্ছে।’’ এর পরেই সেলিমের মন্তব্য, ‘‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। সাগরদিঘি তার ফল। পঞ্চায়েতে ভোট লুট আটকাব আমরা। মানুষ বুঝেছেন যে, সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরি করে তাদের ঠকানো হয়েছে। বিজেপি তৃণমূল যৌথ ভাবে সেই কাজ করেছে।’’
২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের মধ্যে জোট গড়ার ডাক দিয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান। তার আগে রাজ্যে কখনও বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের মধ্যে সরাসরি জোট হতে পারে, এমনটা ভাবা যেত না। কিন্তু সে বার ওই প্রস্তাব খারিজ হয়ে গেলেও তা বাস্তবিত হয় ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে। কয়েকটি আসনে বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াই হলেও, সার্বিক জোট হয়েছিল দু’দলের মধ্যে। সেই সময়ে ভোটপ্রচারে বেরিয়ে কংগ্রেস-বামফ্রন্টের জোটকে ‘কংরেড’ বলে আক্রমণও করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু বিধানসভা ভোটে সেই জোট পরাজিত হওয়ার পর আবারও পৃথক ভাবে পথ চলেছিল দু’দল। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে জোট নিয়ে আলোচনা হলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। দু’টি করে আসনে একে অপরের বিরুদ্ধে প্রার্থীও দেয়নি বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস।
২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে আবারও জোট হয় দু’দলের। সেই জোটে শামিল হয়েছিল আব্বাস সিদ্দিকির দল ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ)। ভোটের ফলপ্রকাশের পর দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস। তাদের প্রতিনিধি হিসাবে জয় পেয়েছেন একমাত্র আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকি।
ওই হারের পর ফের পৃথক ভাবে পথ চলতে শুরু করে বাম-কংগ্রেস। তবে বালিগঞ্জ উপনির্বাচনের আগে মান্নান দাবি তোলেন, কংগ্রেস প্রার্থী না দিয়ে ওই কেন্দ্রে বামফ্রন্ট প্রার্থীকে সমর্থন করুক। যদিও সেই প্রস্তাব নাকচ করে সিপিএমের পাশাপাশি প্রার্থী দিয়েছিল কংগ্রেসও। তা সত্ত্বেও মান্নান ফেসবুকে বামপ্রার্থী সায়রা হালিমের হয়ে প্রচারকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা তাঁর উপর বেজায় ক্ষুব্ধ হন। এমনকি, মান্নানকে দল থেকে বহিষ্কার করারও দাবি তুলেছিলেন প্রদেশ নেতাদের একাংশ। সাগরদিঘির ফলপ্রকাশের পর সেই মান্নান বলছেন, ‘‘বালিগঞ্জেও জোট করলে এমন ফল হত। সে দিন আমি জোটের কথা বলেছিলাম বলে বলা হয়েছিল, ঘাড় ধাক্কা দিয়ে কংগ্রেস থেকে বার করে দেওয়া হোক। আজ দেখা গেল আন্তরিক ভাবে জোট করলে বিজেপি ও তার বি-টিম তৃণমূল উভয়কেই হারানো যায়। সাগরদিঘির জনগণ এই বার্তা দিল যে, বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস ঐক্যবদ্ধ হলে মানুষ সঠিক জবাব দিয়ে দেবে। এটাই বড় শিক্ষা।’’ তাঁর আরও সংযোজন, ‘‘একক ভাবে লড়াই করে কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট কেউ কিছু করতে পারবে না। জোটবদ্ধ ভাবেই আমাদের লড়াই করতে হবে। তবেই ফল মিলবে, সাগরদিঘিই তার বড় প্রমাণ।’’
রাজনীতির বৃত্তে যাঁরা ঘোরাফেরা করেন, তাঁদের একাংশের দাবি, এই জোট গঠনের ক্ষেত্রে বার বার লাভবান হয়েছে কংগ্রেস। তুলনামূলক ভাবে ক্ষতি হয়েছে বামফ্রন্টের বড় শরিক সিপিএমের। ২০১৬ সালের জোটে বিরোধী দলের তকমা হারিয়ে তৃতীয় স্থানে নেমে গিয়েছিল বামেরা। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে কংগ্রেসকে বহরমপুর ও মালদহ দক্ষিণ আসনে সমর্থন দিয়েছিল বামফ্রন্ট। সেই দুটি আসনেই জয় এসেছিল কংগ্রেসের। অন্য দিকে, ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসে বিরোধী দলের মর্যাদা পেয়েছিল কংগ্রেস। আবার ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে সিপিএমের দুই প্রার্থী— যাদবপুরে বিকাশ ভট্টাচার্য ও বাঁকুড়ায় অমিয় পাত্র— এঁদের বিরুদ্ধে কাউকে দাঁড় করায়নি কংগ্রেস। ওই দু’টি আসনে তৃণমূল জয় পায়। দ্বিতীয় স্থান পেয়েছিল বিজেপি। তৃতীয় হয়েছিল সিপিএম।
এ প্রসঙ্গে সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘সাগরদিঘিতে ৫১ শতাংশ ভোট ছিল তৃণমূলের। সেখান থেকে তাঁদের ভোট শতাংশ কমে ৩৮-এ নেমে গিয়েছে। বিজেপির ভোট প্রায় ১২ শতাংশ কমেছে। আর বামফ্রন্ট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী ৪০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। এই ফল দেখে বোঝা যাচ্ছে, বাংলার মানুষ আগামী দিনে কী চাইছেন। আমরা দু’দল সংঘবদ্ধ হলে যে বিজেপি বা তৃণমূলকে হারানো সম্ভব, সেই বার্তাই সাগরদিঘির মানুষ দিয়েছেন। আগামী দিনে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস জোটবদ্ধ ভাবেই এগোবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy