সাগরদিঘিতে কেন হারল তৃণমূল? ছবি: সংগৃহীত।
উপনির্বাচনে সাধারণত জয়ী হয় শাসকদলই। ভোট অরণ্যের এই প্রাচীন প্রবাদ এ বার আর সত্যি হল না। সাগরদিঘি বিধানসভার উপনির্বাচনে হেরে গেল বাংলার শাসক তৃণমূল। অতীতে উপনির্বাচনে শাসকের পরাজয়ের নজির নেই, তা নয়। বরং অনেক নজিরই রয়েছে। কিন্তু ২০২১ সালে তৃণমূল বিপুল শক্তি নিয়ে রাজ্যের ক্ষমতা দখল করার পর এই প্রথম তাদের হার। তা-ও এত দিন রাজ্য বিধানসভায় ‘শূন্য’ কংগ্রেসের কাছে।
পরাজয়ের ময়নাতদন্তে একাধিক কারণ উঠে আসছে। বৃহস্পতিবার সকালে গণনা শুরুর পর থেকেই বোঝা গিয়েছিল, সাগরদিঘির আসন ধরে রাখতে পারছে না তৃণমূল। দিনের শেষে ফলাফল তেমনই হয়েছে। বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী বাইরন বিশ্বাসের কাছে হার মানতে হয়েছে শাসকদলের প্রার্থী দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়কে। শাসকদলের এমন ‘অপ্রত্যাশিত’ ফলের পরেই তার কারণ বিশ্লেষণ শুরু হয়ে গিয়েছে বিভিন্ন মহলে।
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মুর্শিদাবাদ জেলার এই আসনে তৃণমূল প্রার্থী সুব্রত সাহা জয়ী হয়েছিলেন ৫০,৮০০-র কিছু বেশি ভোটে। তবে ২০১১ সালে ‘পরিবর্তন’-এর সময় থেকেই ধারাবাহিক ভাবে তৃণমূলের পাশে ছিল সাগরদিঘি। ২০১৬ এবং ২০১১ সালেও ওই আসন থেকে জিতেছিলেন প্রয়াত সুব্রত। তিনি রাজ্যের মন্ত্রীও হয়েছিলেন। তাঁর অকালপ্রয়াণের জন্যই সেই আসনে উপনির্বাচন হয়েছে। যেখানে হেরে গিয়েছে সুব্রতের দল।
তৃণমূলের পরাজয়ের একাধিক কারণে মধ্যে অন্যতম বলে যা মনে করা হচ্ছে, তা হল ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ)-এর বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকিকে একক মাসেরও বেশি সময় ধরে জেলে রাখা। গত ২১ জানুয়ারি দলের প্রতিষ্ঠা দিবসে ধর্মতলায় কর্মসূচি পালনে পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছিলেন ভাঙড়ের বিধায়ক (বিজেপি ছাড়া ২০২১ সালে বিরোধীদের মধ্যে নওশাদই একমাত্র জিতেছিলেন) নওশাদ ও তাঁর দলের কর্মীরা। ওই ঘটনায় তাঁকে গ্রেফতার করে কলকাতা পুলিশ। ফুরফুরা শরিফের পিরজাদাদের বংশধর নওশাদকে জামিন না দিয়ে একের পর এক থানায় নানা ধারায় মামলা দিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল বলে অভিযোগ করেছিল আইএসএফ। ঘটনাচক্রে, বৃহস্পতিবার ভোটগণনার মধ্যেই ৪০ দিন পরে কলকাতা হাই কোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন নওশাদ।
ঘটনাচক্রে, নওশাদ ফুরফুরা শরিফের অন্যতম পিরজাদাও। তৃণমূলের একাংশ মনে করছে, নওশাদের মতো একজন ধর্মীয় এবং সংখ্যালঘু নেতাকে দীর্ঘদিন জেলে আটকে রাখার বিষয়টিকে ভাল চোখে দেখেননি সাগরদিঘির সংখ্যালঘু ভোটাররা। প্রসঙ্গত, সাগরদিঘির ৬৪ শতাংশ ভোটারই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। নওশাদকে আটকে রাখার সিদ্ধান্তকে যাঁরা সাগরদিঘিতে তৃণমূলের হারের অন্যতম কারণ বলছেন, তাঁদের এটাও দাবি যে, ‘লঘু পাপে গুরু দণ্ড’ দেওয়া হয়েছে সিদ্দিকিকে। সংখ্যালঘু বিধায়ককে দীর্ঘদিন জেলে আটক রেখে সংখ্যাগুরুকে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা ‘ব্যুমেরাং’ হয়ে গিয়েছে। সংখ্যালঘু ভোটের বড় অংশ চলে গিয়েছে বাম-কংগ্রেস জোটের পক্ষে। যদিও তৃণমূলের একটা অংশ বলছেন, নওশাদের আটক থাকার সঙ্গে সাগরদিঘির ফলের কোনও যোগাযোগই নেই।
নওশাদ-প্রশ্নকে যাঁরা উড়িয়ে দিচ্ছেন, তাঁদের দাবি, সাগরদিঘিতে বিজেপির ভোট কংগ্রেসের বাক্সে চলে গিয়েছে। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে সাগরদিঘি থেকে বিজেপি প্রার্থী মাফুজা খাতুন পেয়েছিলেন ৫৪ হাজারের বেশি ভোট। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সেই ভোট কমে ৪৫ হাজার হলেও দ্বিতীয় স্থানে শেষ করেছিল বিজেপি। কিন্তু এ বারের এই ভোটের ফলাফলের পরিসংখ্যানের দেখলে এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, বিজেপি ভোটের বড় অংশ চলে গিয়েছে বামফ্রন্ট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থীর ঝুলিতে। ঘটনাচক্রে, ভোটের প্রচারে গিয়ে কংগ্রেসের প্রার্থী বায়রন বিশ্বাস এবং বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর একসঙ্গে ছবি দেখিয়েছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তখনই তিনি অভিযোগ করেন, কংগ্রেস এবং বিজেপি হাত মিলিয়েছে সাগরদিঘিতে। ভোটের ফলাফল দেখে প্রাথমিক ভাবে এই ধারনা হওয়া অসম্ভব নয় যে, বিজেপির ভোট যে হারে কমেছে, তাতে পদ্মের ভোট হাত শিবিরে যাওয়ার জল্পনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
প্রসঙ্গত, এই প্রথম সাগরদিঘি কোনও সংখ্যালঘু বিধায়ক পেল। উপনির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে একমাত্র কংগ্রেসই সংখ্যালঘু প্রার্থী দিয়েছিল। যে সূত্রে তৃণমূলের একাংশ এ-ও মনে করছে যে, দল কোনও সংখ্যালঘু মুখকে প্রার্থী করলে অন্য ফল হতে পারত সাগরদিঘিতে। তবে সেই তত্ত্ব উড়িয়ে দিচ্ছেন দলেরই একাংশ। তাঁদের মতে, সুব্রত তো সংখ্যালঘু প্রার্থী ছিলেন না। তা হলে পর পর তিন বার তিনি ওই আসনে জিতলেন কী করে!
তবে রাজ্য রাজনীতি সম্পর্কে যাঁরা খোঁজখবর রাখেন, তাঁদের একাংশের মতে, বিজেপির ভোট বাক্স বদল করে কংগ্রেসে যদি গিয়েও থাকে, তা হলে তাতে আখেরে ক্ষতি হবে গেরুয়া শিবিরেরই। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে একটি আসনও পায়নি বাম-কংগ্রেস জোট। তাই এই উপনির্বাচনে কংগ্রেস জেতায় রাজ্যের ‘দ্বিতীয় বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি’ হিসেবে এগিয়ে আসতে পারে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস জোট। অদূর ভবিষ্যতে না হলেও সুদূর ভবিষ্যতে সেই সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সে ক্ষেত্রে প্রধান বিরোধী পক্ষের রাজনৈতিক জমি নিয়ে বিজেপির উদ্বেগের কারণ থাকবে। যদিও বিজেপি শিবিরের দাবি, সাগরদিঘিতে কে জিতেছে, তার চেয়েও বড় বিষয়— শাসক তৃণমূল জেতা আসন হেরেছে। এটা রাজ্যের বিরোধী শক্তির জয় বলেই মনে করছে গেরুয়া শিবির।
বিজেপির ভোট যে তাঁদের প্রার্থী পেয়েছেন, তা কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। বৃহস্পতিবার ভোটের ফলাফল স্পষ্ট হওয়ার পরে তিনি বলেছেন, ‘‘আমাদের প্রার্থী যেমন বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের জোটের ভোট পেয়েছেন, তেমনই পেয়েছেন তৃণমূলের বিক্ষুব্ধদের ভোটও। তা ছাড়া যে সব বিজেপি ভোটাররা তৃণমূলকে হারাতে চেয়েছিলেন, তাঁরাও কংগ্রেস প্রার্থীকে ভোট দিয়েছিলেন।’’
পর পর তিন বারের জেতা আসন হাতছাড়া হওয়ায় প্রশ্নের মুখে পড়েছেন জঙ্গিপুর সাংগঠনিক জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব। হারের কারণ ব্যাখ্যা করতে শীর্ষ নেতৃত্ব তাঁদের তলব করতে পারে বলে সূত্রের খবর। তৃণমূলের একটি সূত্রের দাবি, সুব্রতের সাগরদিঘিতে অনেকটাই ‘ব্যক্তিগত ভোট’ ছিল। সেখানে তাঁর অনুগামীর সংখ্যাও ছিল প্রচুর। সে কারণেই সংখ্যালঘু অধ্যুষিত কেন্দ্র হলেও সুব্রত সাগরদিঘিতে পর পর তিন বার জিতেছিলেন। তৃণমূলের অন্দরে সাগরদিঘির ইতিহাস সম্পর্কে অবহিতেরা বলছেন, এ বারের প্রার্থী দেবাশিসের সঙ্গে সুব্রতের কখনওই সুসম্পর্ক ছিল না। বস্তুত, ২০২১ সালের ভোটে দেবাশিস তৃণমূলের হয়ে প্রচারে যাননি বলেও দলেই একাংশের দাবি। উল্টে তিনি বিরোধী শিবিরেরই বেশি ‘আস্থাভাজন’ ছিলেন। তাঁকে প্রার্থী করায় দলের একটি অংশ এই ভোটে সে ভাবে ‘সক্রিয়’ হয়ে রাস্তায় নামেননি বলে দলের একাংশের দাবি। ফলে প্রার্থী বাছাই নিয়েও তৃণমূলের অন্দরে খানিকটা অনুযোগ ছিল বলেই দলের ওই অংশের দাবি। যদিও তৃণমূলের কোনও স্তরের নেতাই আনুষ্ঠানিক ভাবে বিষয়টি স্বীকার করেননি। বরং তাঁদের বক্তব্য, দেবাশিসকে সাগরদিঘি আসনে ‘সর্বোৎকৃষ্ট’ প্রার্থী হিসেবেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। তবে এই সমস্ত বিষয়ই সাগরদিঘির ফলাফল পর্যালোচনায় খতিয়ে দেখা হবে বলে তৃণমূল সূত্রের খবর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy