প্রতীকী ছবি।
ভিতরে কেউ নেই। অথচ, অফিসের শৌচাগারের সামনে তাঁকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে বেশ কিছু ক্ষণ। ভিতরে ঢুকতে চেয়ে শত অনুরোধের পরেও সহকর্মীদের কাছ থেকে একটাই প্রশ্ন ছুটে আসছে বারবার, ‘‘তুই কোন বাথরুমে যাবি, আগে বল। ছেলেদেরটায় না মেয়েদেরটায়?’’
সে দিন কোনও মতে বসের কেবিনে ঢুকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন সোদপুরের বাসিন্দা সোনালি রায়। সাহায্য বলতে শুধু বসের কেবিনের শৌচালয়টা সে দিন ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। পরে অবশ্য চাকরিটাই চলে যায় তাঁর। সেক্টর ফাইভের এক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় মাস তিনেক কাজ করার সেই অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে সোনালি বলছিলেন, ‘‘আমি কী কাজ করতে পারি, তা কেউ দেখতে চায়নি কখনও। আমি ছেলে না মেয়ে— সে দিকেই ছিল সকলের নজর। প্রতিদিন অপমানিত হতে হতে আর পেরে উঠছিলাম না। এক দিন অফিস জানিয়ে দিল, আমাকে আর দরকার নেই।’’
সোনালির দাবি, ‘‘আমাদের জন্য শুধু আইনই আছে। কার্যক্ষেত্রে তার কোনও ব্যবহার নেই। আমরা কাজ করে খেতে পারছি না। বেঁচে থাকাটাই আমাদের জন্য মস্ত ব়ড় চ্যালেঞ্জ।’’
আরও পড়ুন: বিধায়কের সই পেতে হন্যে ক্যানসার আক্রান্তের বাবা
সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিয়েছে, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদেরও অন্য আর পাঁচ জনের মতো সমান অধিকার প্রাপ্য। তবে সেই নির্দেশিকা এই রাজ্যে খাতায়-কলমেই রয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ অনেকের। বাস্তবে প্রতি পদেই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা নানা রকম বাধাবিঘ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন বলে অভিযোগ। ২০১৫ সালে এ রাজ্যেই প্রথম তৈরি হয় ‘ট্রান্সজেন্ডার ওয়েলফেয়ার বোর্ড’। তাতে অবশ্য রূপান্তরকামীদের সমস্যার সুরাহা হয়নি। তাঁদের একটা বড় অংশেরই অভিযোগ, ওই ওয়েলফেয়ার বোর্ডও রূপান্তরকামীদের আর পাঁচ জনের মতো কাজ করে বেঁচে থাকার অধিকার সুনিশ্চিত করতে পারেনি।
স্কুলে চাকরি খুঁজতে গিয়ে সেই অভিজ্ঞতাই হয়েছে রূপান্তরকামী সুচিত্রা দে-র। ইংরেজিতে ডবল এমএ, বিএড সুচিত্রাকে ইন্টারভিউ চলাকালীন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি শিশুর জন্ম দিতে পারবেন কি না। জন্মের পরে সন্তানকে তিনি মাতৃদুগ্ধ পান করাতে সক্ষম কি না, তা-ও জানতে চাওয়া হয়েছিল। সুচিত্রার দাবি, ‘‘আমার সিভি দেখে কয়েকটি স্কুল ডেকেছিল। তবে ইন্টারভিউয়ে পড়াশোনা নিয়ে প্রায় কোনও কথাই বললেন না কেউ। তার বদলে কেন লিঙ্গ পরিবর্তন করেছি, সেই আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সকলে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘খুব অপমানিত লেগেছিল। চাকরির এতই দরকার যে, মুখের উপরে কথা বলে বেরিয়ে আসতেও পারছিলাম না।’’
বিষয়টি জানিয়ে গত ১১ জুন রাজ্য মহিলা কমিশনে চিঠি দিয়েছেন সোনালি। মহিলা কমিশন বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, ‘‘মহিলা হিসেবে যে কেউ অভিযোগ করলেই খতিয়ে দেখা হয়। ওই মহিলার অভিযোগও দেখা হচ্ছে।’’ ‘ট্রান্সজেন্ডার ওয়েলফেয়ার বোর্ড’-এর ভাইস চেয়ারপার্সন, লিঙ্গ রূপান্তরিত মহিলা মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘যথেষ্ট কাজ হচ্ছে। অভিযোগ পেলেই সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে। বাকি সমস্যাগুলিরও আগামী দিনে সমাধান হয়ে যাবে।’’
তাঁদের যে পরিমাণ মানসিক অপমান সহ্য করতে হয়, তার অধিকাংশ ঘটনারই অভিযোগ করার সুযোগ থাকে না বলে দাবি রূপান্তরকামীদের একটি বড় অংশের। যেমন কলেজপড়ুয়া, বছর একুশের অনুপম সরকার জানালেন, ক্রিকেট, ফুটবলের চেয়ে খেলনাবাটি, পুতুল খেলা তাঁর বেশি পছন্দ। বললেন, ‘‘এই অন্য রকম ভাবতে চাওয়া বা করতে চাওয়াটা কি অন্যায়? কলেজে যে ভাবে প্রতিদিন অপমানিত হতে হচ্ছে, জীবনেও ভুলতে পারব না। কাকে অভিযোগ করব? আর করেই বা লাভ কী হবে?’’ তাঁর কথায়, ‘‘অন্তরে এবং বাহিরে মিল হয়নি সে কালে এবং এ কালেও! আর মিল না হলে শুধু আইনই তৈরি হয়, তা কাজে লাগে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy