Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

খেয়া টেনেই সংসার চলে প্রভার

ছোট নৌকোয় ছোট ছই। তার ভেতর সারাক্ষণের সঙ্গী রেডিও, পান-বাটা, জলের বোতল, কাঁথা, চটের বস্তা। কোমরে গামছা বেঁধে সেই নৌকোর কিনারায় বসে পঞ্চান্ন বছরের প্রভা মণ্ডল। হাতে কাছি। সেই কাছি বাঁধা সুতারবাগ নদীর দুই তীরের দু’টি খুঁটিতে। তিনিই দড়ি খেয়ার পাটনী। সুন্দরবনে বহু নদীনালার কোথাও মহিলা পাটনীর এমন উদাহরণ আছে কি না, জানেন না যাত্রীরা। জানেন না তিনিও।

চলছে পারাপার। নিজস্ব চিত্র।

চলছে পারাপার। নিজস্ব চিত্র।

অমিত করমহাপাত্র
রায়দিঘি শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৪ ০১:৩৭
Share: Save:

ছোট নৌকোয় ছোট ছই। তার ভেতর সারাক্ষণের সঙ্গী রেডিও, পান-বাটা, জলের বোতল, কাঁথা, চটের বস্তা। কোমরে গামছা বেঁধে সেই নৌকোর কিনারায় বসে পঞ্চান্ন বছরের প্রভা মণ্ডল। হাতে কাছি। সেই কাছি বাঁধা সুতারবাগ নদীর দুই তীরের দু’টি খুঁটিতে। তিনিই দড়ি খেয়ার পাটনী।

সুন্দরবনে বহু নদীনালার কোথাও মহিলা পাটনীর এমন উদাহরণ আছে কি না, জানেন না যাত্রীরা। জানেন না তিনিও। পাথরপ্রতিমার কাওরাখালি গ্রামের বাসিন্দা প্রভাদেবী বলেন, “বাবা খেয়া পারাপার করতেন। মারা গেলেন। ভাই হার্টের রোগী। বাধ্য হয়ে আমাকেই এ দায়িত্ব নিতে হল।”

পাথরপ্রতিমা, মথুরাপুর-২ ব্লকের বাসিন্দারা মূলত প্রাত্যহিক প্রয়োজনে এই হাজরাঘেরি-কাওরাখালি জলপথে খেয়া ব্যবহার করেন। সারা দিনে গড়ে দেড়শো-দু’শো জন পারাপার করেন। ভাড়া তিন টাকা। সকলে সে টাকা দেন না। অনেকে ধার রেখেও মেটান না। উপার্জন যাই হোক না কেন, নদী বা নৌকো ছেড়ে এলে মন খারাপ হয় প্রভা দেবীর। ভাই ভোলানাথ মণ্ডল বলেন, “কত দিন এমন হয়েছে, সারা দিনের ক্লান্তির পরেও দিদি রাত পর্যন্ত নৌকোয় বসে বা শুয়ে থেকেছে।”

দড়ি খেয়ায় হাল ধরতে হয় না। দুই পাড় সংযোগকারী কাছি টেনে টেনে নৌকো পারাপার করেন। সারা দিনের পরিশ্রমে, জলে কাদায় ভেজা কাছি টেনে হাজা হয়ে গিয়েছে হাতে। হাত দেখিয়ে তিনি বলেন, “মলম লাগাব কখন? জল লাগার তো বিরাম নেই। এক জন এলেও তাকে পার করে দিতে হয়। না হলেই কথা শুনতে হবে।” যেহেতু গ্রামের মানুষ তাঁর বাবার হাতে এক সময়ে এই দায়িত্ব দিয়েছিলেন, ফলে তাঁর দায়িত্ব পালনে কমতি দেখলেও অন্য কাউকে খেয়ার দায়িত্ব দিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন কেউ কেউ। কিন্তু তিনি কাজ না করলে সংসারের সাত জনের মুখে খাবার উঠবে না। “তিন ভাইঝির পড়া বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা তো পড়ার সুযোগ পাইনি,”দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফের দড়ি ধরে টানলেন প্রভাদেবী।

পনেরো বছর বয়সে প্রভাদেবীর বিয়ে হয় মহীপীঠের দেবীপুর গ্রামে। বিয়ের মাস তিনেকের মধ্যে নদীতে মাছ ধরার সময় তাঁর স্বামীকে বাঘে টেনে নিয়ে যায়। বাবার কাছে ফিরে এসে সংসারের কাজের ফাঁকে নদী পারাপারের সময়ে বাবার সঙ্গে কাছি ধরতেন। বছর দশেক আগে বাবার মৃত্যুর পর একাই সেই দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন নিজের কাঁধে। দিদির কথা বলতে গিয়ে চোখের জল ধরে রাখতে পারেন না ভাই ও ভাইয়ের বউ। তারা বলনে, “বাবা হাঁপানি রোগী ছিলেন। দিদির ভরসাতেই নৌকো চালাতেন। তাঁর মৃত্যুর পর দিদি সংসারের হাল না ধরলে আমরা ভেসে যেতাম।”

চাষের জমি নেই। বাড়ি লাগোয়া সামান্য বাস্তু জমিতেই সব্জি ফলান ভ্রাতৃবধূ পুষ্প। ভাইয়ের চিকিত্‌সা-সহ সংসারের যাবতীয় খরচ চলে দুই মহিলার শ্রমে। বয়সের ভারে ক্লান্তি ঘিরে ধরে। বলেন, “আর পারি না। সবাই খুব ভালবাসে বলেই মনের জোরে চালিয়ে যাচ্ছি। আমার শরীর খারাপ হলে পুষ্পই খেয়া পার করে।”

নদীবাঁধ থেকে হাঁটু-কাদায় প্রায় দু’শো মিটার হেঁটে নৌকোয় উঠতে হয় বলে এ পথে যাত্রী কম। ভাঁটার সময় যখন যাত্রী আরও কমে। সেই ফাঁকে জিরিয়ে নেন প্রভাদেবী। তখন ছইয়ের ভিতরে বসে রেডিও শোনেন। বলেন, “কত রকমের পাখি আসে। কয়েকটা আবার সাহস করে নৌকায় বসে। অলস দুপুরে মোল্লাদের নদীতে ডুব দিয়ে মাছ ধরা দেখেসময় কেটে যায়।” যাত্রীদের সঙ্গে সুখদুঃখের কথা বলেন তিনি। মনকে বোঝান, জীবনে সুখ-দুঃখ জোয়ার ভাঁটার মতোই। কিন্তু হতাশা চাপতে পারেন না। “বোঝাই বটে। কিন্তু সুখের মুখ দেখলাম না। আমরা বাঁচা- মরা সবই নৌকোয়,” অকপটে বলেন প্রভাদেবী।

পুরুষের কাজ বলেই পরিচিত এই পেশায় প্রভাদেবীর উপস্থিতি যাত্রীদের চোখে ‘অন্য রকম’ ঠেকতেই পারত। কিন্তু ছোট থেকেই ‘মাসি’কে এ ভাবে দেখতে অভ্যস্ত এলাকার অনেকেই। প্রায় দিনের যাত্রী রায়দিঘির সেবাদাসী হালদার, কাওরাখালির গৌতম দাস, গোবিন্দ যাদব বা ভারতী হালদার এই প্রসঙ্গে বলেন, “মাসির লড়াই দেখে আমাদেরও মনের জোর বোড়ে।” আর এক যাত্রী ধনঞ্জয়বাবু বলেন, “ভেতরে ভেতরে প্রভা খুব দুঃখী। খুব কাঁদে। বলে, ‘কোন দিন ভেসে যাব। আর খুঁজে পাবে না’।”

অন্য বিষয়গুলি:

amit karmahapatra raidighi boatman
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE