Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

রাজনীতির প্যাঁচ-পয়জার নিয়ে ভাবছেন না নতুন কাউন্সিলরেরা

ওঁরা সকলেই সদ্য সমাপ্ত গোবরডাঙা পুরভোটে প্রথম বারের জন্য জয়ী হয়েছেন। আনুষ্ঠানিক ভাবে কাউন্সিলর হিসাবে কেউই এখনও শপথ নেননি। কিন্তু আগামী পাঁচ বছর নিজেদের ওয়ার্ডে কী কী কাজ করবেন, তার রূপরেখা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু করে দিয়েছেন। কেউ চাইছেন ওয়ার্ডে শান্তিপূর্ণ সৌহার্দ্যের পরিবেশ তৈরি করতে, কেউ বা চাইছেন ওয়ার্ডে অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে। আবার কেউ চাইছেন ওয়ার্ডে বেআইনি ভাবে চলতে থাকা পুকুর ভরাট রুখতে পদক্ষেপ করার কথা।

সীমান্ত মৈত্র
গোবরডাঙা  শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০১৫ ০২:৪১
Share: Save:

ওঁরা সকলেই সদ্য সমাপ্ত গোবরডাঙা পুরভোটে প্রথম বারের জন্য জয়ী হয়েছেন। আনুষ্ঠানিক ভাবে কাউন্সিলর হিসাবে কেউই এখনও শপথ নেননি। কিন্তু আগামী পাঁচ বছর নিজেদের ওয়ার্ডে কী কী কাজ করবেন, তার রূপরেখা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু করে দিয়েছেন। কেউ চাইছেন ওয়ার্ডে শান্তিপূর্ণ সৌহার্দ্যের পরিবেশ তৈরি করতে, কেউ বা চাইছেন ওয়ার্ডে অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে। আবার কেউ চাইছেন ওয়ার্ডে বেআইনি ভাবে চলতে থাকা পুকুর ভরাট রুখতে পদক্ষেপ করার কথা। রাস্তা-ঘাট, পানীয় জল, নিকাশি ব্যবস্থার উন্নতির ইচ্ছে তো আছেই। রাজনীতির জটিল অঙ্কের মধ্যে ঢুকতে চাইছেন না অনেকেই। উন্নয়নের কাজ করার আগ্রহটা সকলের মধ্যেই বেশ প্রবল।

রাজনৈতিক দলগুলিও নতুন কাউন্সিলরদের স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দেওয়ার পক্ষপাতী। বিরোধী দলের কাউন্সিলরদেরও উন্নয়নের ক্ষেত্রে যাবতীয় সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে শাসক তৃণমূলের পক্ষ থেকে। পুরসভার বিদায়ী পুরপ্রধান সুভাষ দত্ত (এ বারও যাঁর পুরপ্রধান হওয়ার সম্ভাবনা) বলেন, ‘‘বিরোধী দলের কাউন্সলরদের ওয়ার্ডে উন্নয়নের ক্ষেত্রে একশো শতাংশ সহযোগিতা করা হবে। ভোট হয়ে যাওয়ার পরে সব কাউন্সিলরই পুরসভার কাউন্সিলর।’’

সতেরো আসনের গোবরডাঙা পুরসভায় এ বার শাসক তৃণমূল পেয়েছে ১৩টি আসন। বামেরা পেয়েছে দু’টি ও নির্দল প্রার্থীরা দু’টি আসনে জয়ী হয়েছেন। সতেরো জন কাউনিন্সলের মধ্যে এগারো জন কাউন্সিলর এ বার নতুন। সিপিএমের গোবরডাঙা শহর লোকাল কমিটির প্রাক্তন সম্পাদক শঙ্কর নন্দী বলেন, ‘‘আমাদের নতুন কাউন্সিলরদের বলে দেওয়া হয়েছে, ওয়ার্ডের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে একটি ওয়ার্ড উন্নয়ন কমিটি তৈরি করতে। ওই কমিটির সুপারিশ মতো কাজ করতে। তা ছাড়া, রাজনৈতিক ভাবে আমরা নতুন কাউন্সিলরদের পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করব।’’ তৃণমূলের গোবরডাঙা শহর কমিটির কার্যকরী সভাপতি শঙ্কর দত্ত দলের নতুন কাউন্সিলরদের প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘ওয়ার্ডের উন্নয়নের ক্ষেত্রে নতুন কাউন্সিলদের মতামতকে আমরা সর্বাধিক গুরুত্ব দেবো। নতুন কাউন্সিলরদের কাজ করতে সব রকমের সহযোগিতা করা হবে। উন্নয়নের কাজে কোনও রকম হস্তক্ষেপ করা হবে না।’’

১৫ নম্বর ওয়ার্ড থেকে এ বার নিদর্ল প্রার্থী হিসাবে ভোটে দাঁড়িয়ে জয়ী হয়েছেন পেশায় বিমা সংস্থার এজেন্ট বিশ্বনাথ চক্রবর্তী। তিনি পরাজিত করেছেন পুরসভার বিদায়ী উপ পুরপ্রধান তথা দীর্ঘদিনের কাউন্সিলর তৃণমূলের অসীম তরফদারকে। জয়ের ব্যবধান ৩০৯ ভোটের। বিশ্বানাথবাবু সদ্য প্রাক্তন গোবরডাঙা শহর যুব তৃণমূলের সভাপতি। দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়ানোর পরে তৃণমূল তাঁকে বহিষ্কার করেছে। যদিও এ বারের ভোটে ওয়ার্ডের বেশির ভাগ তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের সমর্থন তিনি পেয়েছেন। স্থানীয় নেতৃত্বের একাংশের সহযোগিতাও তিনি পেয়েছেন। ওয়ার্ডের সাধারণ মানুষ ও তৃণমূল কর্মীদের দাবি মতোই তিনি ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। অসীমবাবু ওই ওয়ার্ডের বহিরাগত প্রার্থী ছিলেন। ভোটের প্রচারে বেরিয়ে ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে বিশ্বনাথবাবু ওয়ার্ডের নানা সমস্যার কথা জানতে পেরেছেন। প্রচারে ওই সব সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। ভোটে জয়ী হয়ে বিশ্বনাথবাবু ওই সব প্রতিশ্রুতির কথা ভোলেননি। তাঁর কথায়, ‘‘আমার ওয়ার্ডটি স্থানীয় কঙ্কনা বাওর দিয়ে ঘেরা। বহু মানুষ সেখানে স্নান করতে যান। সেখানে নতুন ঘাট তৈরির বিষয়টি অগ্রাধিকার দেবো। তা ছাড়া, নিকাশি ব্যবস্থা ঢেলে সাজতে হবে। বর্ষায় দু’একটি এলাকায় জল দাঁড়িয়ে যায়। আর ওয়ার্ডের সব বাড়িতে পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ায় হবে আমার লক্ষ্য।’’ ভোটে জেতার পরে তিনি কথা বলেছেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ও জেলা যুব তৃণমূল সভাপতি পার্থ ভৌমিকের সঙ্গে। বিশ্বনাথবাবু বলেন ‘‘আমি ওয়ার্ডে না দাঁড়ালে ওয়ার্ডটিতে সিপিএম প্রার্থী শ্যামল ভট্টাচার্য জয়ী হতেন। সে কারণে ভোটে দাঁড়াতে হয়েছিল। আমি তৃণমূলেই ফিরে যেতে চাই।’’

৯ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ভোটে প্রথমবার দাঁড়িয়েই জয়ী হয়েছেন শাসক দলের প্রার্থী বছর সাঁইত্রিশের সঞ্জয় মণ্ডল। তিনি একটি বেসরকারি স্কুলে পড়ান। যে ওয়ার্ডটি থেকে তিনি জয়ী হয়েছেন, সেটি সিপিএম দুর্ভেদ্য দুর্গ হিসাবে পরিচিত ছিল। বহু বছর ধরে ওয়ার্ডটি সিপিএমের দখলে ছিল। সঞ্জয়বাবু পরাজিত করেছেন সিপিএম প্রার্থী শমীক সরকারকে। ভোটের আগের দিন রাতে ওই ওয়ার্ডের তৃণমূল কর্মীদের মারধরের অভিযোগ উঠেছিল সিপিএমের লোকেদের বিরুদ্ধে।

ওয়ার্ডের সমস্যার কথা বলতে গিয়ে সঞ্জয়বাবু জানালেন, ‘‘ওয়ার্ডে সর্বত্র পানীয় জলের ট্যাপের লাইন পৌঁছয়নি। রাস্তার হালও খারাপ। ওই সমস্যাগুলি সমাধানের দিকে নজর দেবো। ওয়ার্ডের বহু মানুষ দিনমজুর। তাঁদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।’’

৭ নম্বর ওয়ার্ড থেকে জয়ী হয়েছেন তৃণমূলের বাসন্তী ভৌমিক। বয়স ছত্রিশ বছর। গৃহবধূ বাসন্তীদেবী এ বারই প্রথমবার ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি ২১৬ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন। বললেন, ‘‘আমার প্রথম এবং প্রধান কাজ হবে ওয়ার্ডের মানুষের বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ানো। দু’একটি রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। সেগুলি সংস্কার করব। তা ছাড়া, পানীয় জলের সমস্যা আছে। তারও সমাধান করতে হবে।’’

১০ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ভোটে দাঁড়িয়ে প্রথমবারের জন্য জয়ী হয়েছেন সিপিএমের বিশ্বনাথ বিশ্বাস। বছর সাঁইত্রিশের বিশ্বনাথবাবু চাষবাস করেন। দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে তিনি বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তিনি ১১৩ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছেন শাসক দলের বিশ্বনাথ চক্রবর্তীকে। ওয়ার্ড ছিল তৃণমূলের দখলে। জয়ী প্রার্থী বললেন, ‘‘ওয়ার্ডটিতে বহু গরিব মানুষ বসবাস করেন। অনেকের বাড়ির মাথায় ছাদ নেই। হয় ভাঙা টালি বা প্লাস্টিক দেওয়া। রাস্তাঘাট অবশ্য ভাল। বেশির ভাগ এলাকায় পানীয় জলের ট্যাপের লাইন যায়নি। পানীয় জলের সমস্যা আছে।’’ জানালেন, কাউন্সিলর হিসাবে শপথ নেওয়ার পরে প্রথম কাজ হবে, মানুষের অভাব-অভিযোগ মন দিয়ে শোনা এবং তাঁদের পাশে দাঁড়ানো। বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করব। অর্থনৈতিক ভাবে তাঁদের বিভিন্ন সরকারি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সাহায্য করব।’’

১৬ নম্বর ওয়ার্ড থেকে প্রথমবারের জন্য ভোটে দাঁড়িয়ে জয়ী হয়েছেন বাহান্ন বছরের প্রৌঢ়া দীপ্তি রায়। তিনি বাম সমর্থিত নির্দল প্রার্থী ছিলেন। ২৩২ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছেন তৃণমূল প্রার্থীকে। তিনি জানালেন, ওয়ার্ডের নিকাশি ব্যবস্থার হাল খুবই খারাপ। নিকাশি নালা তৈরি হয়নি সে ভাবে। কিছু কিছু রাস্তা হলেও অনেক রাস্তা এখনও করতে হবে। আর রয়েছে পানীয় জলের সমস্যা। বাড়ি বাড়ি পানীয় জল পৌঁছে দিতে হবে। দীপ্তিদেবী বলেন, ‘‘ওয়ার্ডের আর একটি বড় সমস্যা বেআইনি ভাবে পুকুর ভরাট করা। এখনও জামদানি এলাকায় একটি বড় পুকুর ভরাটের কাজ চলছে। বহু মানুষ ওই পুকুরে স্নান করেন। কাউন্সিলর হিসাবে ওই পুকুর ভরাট বন্ধ করব।’’ পাশাপাশি তিনি দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করা মানুষকে আর্থিক ভাবে সাহায্য করবেন বলেও জানালেন। বার্ধক্য ভাতা, বিধবা ভাতার ব্যবস্থাও করতে চান বলে জানিয়েছেন।

১৭ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ভোটে জিতেছেন সিপিআই প্রার্থী স্বপন সরকার। তিনি পরাজিত করেছেন তৃণমূলের বিদায়ী কাউন্সিলর গোবিন্দ মণ্ডলকে। দলীয় কর্মী হিসাবে তিনি বহু দিন কাজ করছেন। বছর পঁয়তাল্লিশের স্বপনবাবু বিমা সংস্থার কর্মী। জানালেন, নিকাশি নালাগুলি অবৈজ্ঞানিক ভাবে তৈরির ফলে তা দিয়ে জল বের হয় না। ট্যাপের জল এখন বহু বাড়িতে পৌঁছয়নি। রাস্তাঘাটও নতুন করে বেশ কিছু তৈরি করতে হবে। তবে কাউন্সিলর হিসাবে তিনি প্রথমেই লক্ষ্য দেবেন, শান্তি বজায় রাখতে। আইন-শৃঙ্খলা ঠিক করবেন। সৌহার্দ্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক পরিবেশ তৈরিতে জোর দেবেন বলেও জানিয়েছেন এই প্রার্থী।

শাসক দলের হয়ে, ৪ নম্বর ওয়ার্ড থেকে বুলি দত্ত, ৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ঝুমা বন্দ্যোপাধ্যায়, ১২ নম্বর ওয়ার্ড থেকে রত্না বিশ্বাস, ৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকে চায়না সিংহ এবং ১৪ নম্বর ওয়ার্ড থেকে তুষারকান্তি ঘোষ প্রথমবারের জন্য জয়ী হয়েছেন। বুলিদেবীর স্বামী তথা শহর তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি শঙ্করবাবুও ভোটে জিতেছেন। স্বামীর ছত্রচ্ছায়া থেকে বেরিয়ে বুলিদেবী ওয়ার্ডের জন্য কেমন কাজ করেন, সে দিকেও ওয়ার্ডের মানুষ তাকিয়ে রয়েছেন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE