লড়াকু: নিজেদের খাবারের দোকানে সুনীতা ও উত্তম। শ্যামনগরে। নিজস্ব চিত্র।
মেয়েটি বলেছিল, ‘‘ফেসবুকে দেখেছ তো কী! সামনাসামনি দেখলে তুমি আর আমার মুখই দেখবে না!’’ কিন্তু বাস্তবে হল উল্টোটা। সুনীতা দত্ত বললেন, “উত্তম যেন এর পরে আরও মায়া, যত্ন, ভালবাসায় আমার জন্য পাগল হয়ে উঠল!”
উত্তম আঁকুড়ে বলতে থাকেন, “আমরা কে আর নিখুঁত বলুন! এই যে আমি সুনীতার থেকে মাথায় খাটো! আমার ডান পায়ের দু’জায়গায় ভাঙা। পা মুড়তে পারি না। মাসে মাসে ডাক্তার, ওষুধের ধাক্কা! ছোটবেলায় গ্রামে যাত্রা দেখার ভিড়ে চাপা পড়ে এখনও ভুগছি! তার বেলা?”
সুনীতারও মুখে ২১টা অস্ত্রোপচার হয়েছে। একটি চোখে আঁধার। একটা কান নেই! উত্তম সেই অ্যাসিড-দগ্ধ মেয়ের চোখে চোখ রাখেন, ‘‘আমাদের সাধের হোটেলের মুখ কিন্তু তুমিই! এক বার সব কিছু দাঁড়িয়ে যাক! ধারগুলো শোধ করি… তখন হয়তো তোমার নামে নামও রাখব হোটেলের।’’
ইছাপুর স্টেশনের কাছে শ্যামনগরের কমলপুরে চিলতে খাবারের দোকানে এখন সন্ধে হলেই দম ফেলার ফুরসত থাকে না নবদম্পতি সুনীতা-উত্তমের। জিম-ফেরত ছেলেরা চায় চিকেন ক্লিয়ার সুপ আর পিৎজ়া! পথচলতি লোকের চাহিদা, রোল, মোমো বা চাউমিন, ফ্রায়েড রাইস। কমজোরি পায়ে বেশি ভারী জিনিস তোলা নিষেধ উত্তমের। কিন্তু লিকপিকে হাতেই দিব্যি বিরিয়ানির হাঁড়ি, চাউমিনের কড়াই নাড়েন তিনি। টুকটাক সাহায্য করা ছাড়াও সুনীতার জিম্মাতেই রয়েছে হোটেলের ক্যাশবাক্সের ভার! বছরখানেক আগে বিয়ের পরে ইছাপুরেই ঘর বেঁধেছেন ওই যুগল।
আগরা, নয়ডায় অ্যাসিড-আক্রান্তদের নিয়ে শিরোজ় হ্যাংআউট কাফের কথা এ দেশ জেনেছে কয়েক বছর আগে। শ্যামনগরে সুনীতা-উত্তমের স্বপ্নের উড়ানের বয়স মোটে কয়েক মাস। সুনীতার আত্মীয় পীযূষ দে-র থেকে ম্যাশআপ নামের দোকানটি নিয়ে ক্রমশ ধারমেটাচ্ছেন নবদম্পতি। নতুন বঙ্গাব্দের পদধ্বনির আবহে দু’জনে স্বপ্নদেখেন, আর কত দিনে সব কিছু মনের মতো হবে। উত্তম বলেন, ‘‘আমি তো আগে আসানসোলের হোটেলেকত রান্নাই শিখেছি! তুমি বলো তো, পয়লা বৈশাখ স্পেশাল পরোটাআর চিকেন দোপিঁয়াজা রাখলেকেমন হয়!’’
হরিয়ানা, পঞ্জাবে তা-ও মাসে মাসে খরচ পান অ্যাসিড-আক্রান্তেরা। এ রাজ্যে সে গুড়ে বালি।২০১০-এ স্বরূপনগর এলাকায় থাকার সময়ে ক্লাস নাইনের সুনীতার মুখে অ্যাসিড মারে স্থানীয় দুর্বৃত্ত।রণজিৎ তরফদার নামে সেই অভিযুক্ত আজও অধরা। সম্ভবত হাকিমপুর সীমান্ত দিয়ে সে দেশছাড়া। ২০১৮ সালের পরে দফায় দফায় ১২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পান সুনীতা।তার অর্ধেক গিয়েছে অস্ত্রোপচারের ধার মেটাতে। বাকি অর্ধেক ব্যাঙ্কে থাকার দরুণ মাসে আড়াই হাজারটাকা সুদ পান। হাই কোর্টের নির্দেশ, দশ বছর সে টাকায় হাত দেওয়াচলবে না।
সুনীতা বলেন, “দোকানটা দাঁড় করাতে দু’লক্ষের মতো টাকা খুবই দরকার!” আপাতত দিল্লির অ্যাসিড-আক্রান্ত বীরাঙ্গনা শাহিন মালিক এবং অ্যাসিড-নির্যাতিতাদের জন্য শাহরুখ খানের সংগঠন পাশে দাঁড়িয়েছে সুনীতাদের। মাসে মাসে উত্তমের চিকিৎসার টাকা দিয়েও তাঁরা সাহায্য করছেন।
কলকাতায় শাহিনের সহযোগী অপরাজিতা গঙ্গোপাধ্যায় সুনীতার কাছে বড় দিদির মতো। সুনীতা বলেন, “এমন কয়েক জনের সাহায্যেই লড়াই চালাচ্ছি। আর ভাগ্যিস, উত্তম পাশে আছে!”
পানাগড়ে উত্তমের পরিবার এখনও ছেলে-বৌমার সম্পর্কটা নিয়ে আড়ষ্ট। বৃহত্তর সমাজেও নানা বাধা। কিন্তু ভালবাসার জোরে নবদম্পতির স্বপ্ন দেখার স্পর্ধাই শেষ কথা বলছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy