টিভিতে রাজীব হত্যার রায় শুনছেন মৌসুমী কয়াল। বৃহস্পতিবার কামদুনিতে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
উদ্বেগে টানটান গোটা ঘর। বাড়ির লোকজন তো আছেনই, এসেছেন পড়শিরাও। সবার চোখ টিভির পর্দায়। বেলা সাড়ে ১১টায় রায় ঘোষণা হল। একগাল হেসে বাড়ির মালকিন বললেন, “যাক, ওরা দোষী সাব্যস্ত হল।”
মালকিন মানে মৌসুমী কয়াল। কামদুনিতে গণধর্ষণের প্রতিবাদে সামাজিক আন্দোলনের অন্যতম মুখ।
বিচার পাওয়ার লড়াই কত কঠিন, জানে বলেই রাজীব হত্যার রায় শুনতে উৎসুক ছিল কামদুনি। পড়শি বৃদ্ধা সন্ধ্যা ঘোষ বললেন, “কবে আমাদের ঘটনার রায় বের হবে, পথ চেয়ে বসে আছি আমরা।” একই আর্জি কামদুনির নিহত ছাত্রীর জেঠিমার। ছাত্রীর বাবা-মা-ভাইয়েরা এখন আর গ্রামে থাকেন না। জেঠিমা এ দিন বললেন, “দিদি (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) ওদের পরিবারের জন্য অনেক কিছু করেছেন। এ বার দোষীদের সাজা দিন।” বলতে বলতেই চোখ জলে ভরে আসে তাঁর, “মেয়েটার কথা ভাবলে বুকটা ঝাঁঝরা হয়ে যায়। ‘বড়মা’ বলে ডাকটা আজও কানে বাজে।”
২০১৩-র ৭ জুন গণধর্ষণের সেই ঘটনার পরে রাস্তায় নেমেছিল গোটা গ্রাম। দেড় বছর পেরিয়ে সেই একতার ছবিতে অবশ্য চিড় ধরেছে। নিহত তরুণীর পরিবারের সদস্যরা সরকারি চাকরি নিয়ে চলে যাওয়ার পর ফাটল আরও চওড়া হয়েছে। মৌসুমীর বাড়িতে টিভি দেখার ভিড়ে সামিল হতে রাজি হলেন না তাঁরই এক নিকট-আত্মীয়া। শোনা গেল, সম্প্রতি তিনি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চাকরি পেয়েছেন, শাসক দলের আনুকূল্যে।
সামনের একটি ক্লাবে ক্যারম খেলায় ব্যস্ত ছিলেন কয়েক জন যুবক। রাজীব হত্যার রায় নিয়ে প্রশ্ন করলে ঝাঁঝিয়ে উঠে তাঁদের এক জন বলেন, “আমরা রাজীব হত্যা বা কামদুনির ঘটনা সম্পর্কে কিছু জানি না। জানতে হলে মৌসুমীর বাড়িতে চলে যান।”
এই একটি ‘পরিবর্তন’ ছাড়া, কামদুনি কিন্তু আছে কামদুনিতেই। আর বদল বলতে শুধু গ্রামের বাইরে মাথা তুলেছে বাহারি গেট, তাতে লেখা ‘কামদুনি গ্রাম।’
বারাসত স্টেশন লাগোয়া জেলাশাসকের অফিসের সামনে দিয়ে বাড়ি ফেরার সময়েই মদ্যপরা আক্রমণ করেছিল রাজীব আর রিঙ্কুকে। সেই ঘটনার পরে ক্রুদ্ধ এলাকাবাসীরা বলেছিলেন, রাস্তায় আলো জ্বলে না। পুলিশ থাকে না। তাই দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য দিনদিন বাড়ছে। রাজীবের প্রাণের বিনিময়ে সেই রাস্তায় এখন আলো জ্বলেছে। কামদুনির ঘটনার পরে বারাসত থানা ভেঙে চারটি নতুন থানা হয়েছে।
কামদুনিতে কিন্তু দিনদুপুরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসার সময় আক্রান্ত হয়েছিলেন ছাত্রীটি। সুতরাং রাতে সে পথের কী দশা হয়, সহজেই অনুমেয়। কামদুনিবাসীর দাবি সত্ত্বেও এখনও সেখানে আলো জ্বলে না। সারি সারি খুঁটিই বসেছে কেবল। তাদের মাঝে লাগানো হয়েছে সারি দিয়ে গাছ। বাসিন্দাদের আশঙ্কা, ওই গাছ বড় হলে বিপদ আরও বাড়বে নাতো? কদাচিৎ রাতে টহল দেয় পুলিশ। দিনে ভ্যানরিক্সা চললেও, সন্ধ্যার পর তা কমে আসে। তখন ডাক্তারের কাছে যেতেও ভয় পান বাসিন্দারা। আজও গ্রামের মেয়েরা কলেজ থেকে ফেরার সময় তাদের ভাই কিংবা বাবাকে গিয়ে দাঁড়াতে হয় বাসস্ট্যান্ডে। ঠিক যেমন রাজীব স্টেশন থেকে আনতে যেত তার দিদিকে।
সেই জন্যই বহু হুমকি সহ্য করেও আন্দোলন থেকে পিছু হটতে নারাজ মৌসুমী কয়াল আর তাঁর সঙ্গীরা। মৌসুমীর কথায়, “অনেকে আমাকে বলেন, যাঁদের মেয়ে তাঁরা তোচাকরি পেয়ে চলে গিয়েছে। তুমি লড়ছ কেন? আমি বলি, আমার মেয়ে আছে। এক দিন বড় হবে। ভবিষ্যতে তার সঙ্গে যেন এমন ঘটনা না ঘটে তার জন্যই আমার আন্দোলন চলবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy