ঝকঝকে রাস্তা, ভেপার ল্যাম্পের আলো, সাজানো বাস স্ট্যান্ড, বাঁধানো গঙ্গার ঘাট সব আছে। ২৩টি ওয়ার্ডের পুরসভা হিসাবে হালিশহর নিজেকে বেশ গুছিয়ে নিয়েছে। নগরজীবন নিয়ে বাসিন্দারা অনেকটাই নিশ্চিন্ত। ১৯০৩ সালে তৈরি হওয়া হালিশহর পুরসভার যে ছবিটা প্রবীণ এলাকাবাসীদের মনের মধ্যে রয়ে গিয়েছে তার সঙ্গে আজকের শহরের ফারাক আকাশ-পাতাল।
ঘোষপাড়া রোডের উপরে পুরসভার মিউজিয়ামে ধরা আছে পুরনো শহরের বহু স্মৃতি। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের অন্য শহরগুলো যা পারেনি, হালিশহর তা করে দেখিয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন, “বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি।” তাঁর নিজের শহর নৈহাটির পুরপ্রধান ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। হালিশহর ছিল নৈহাটি পুরসভারই একটি অংশ। সেই পুরসভায় তাঁর একটা স্বাক্ষর দূরের কথা, পুরনো পুরপ্রধানদের নামের তালিকা পর্যন্ত নেই। হালিশহর অবশ্য অতীতকে মর্যাদা দিয়েই বেড়ে উঠেছে। পুরপ্রধানের ঘরের বাইরে প্রথম পুরসভা তৈরি হওয়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত যত জন পুরপ্রধান হয়েছেন, সময়কাল ধরে তাঁদের নামের তালিকা রয়েছে। নিজস্ব ওয়েবসাইট তৈরি করেছে। হালিশহরকে ইকো ট্যুরিজম-এর অন্যতম কেন্দ্র হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ওয়েবসাইটে পুরসভার অন্তর্গত দর্শনীয় জায়গাগুলির খতিয়ান ছাড়াও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের ফিরিস্ত আছে। অনলাইন খাজনা নেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। সাধারণ বাসিন্দাদের যে কোনও অভাব-অভিযোগ নেওয়ার জন্যও একটি পোর্টাল আছে।
পুরসভার সামনে এই শহরের প্রধান রাস্তার আলঙ্কারিক নাম হয়েছে কর্নেল কেপি গুপ্ত রোড। হালিশহরের অন্যতম রূপকার কালীপদ গুপ্তে নামেই রাস্তার নাম। কালীপদবাবু ১৯০৫ সালে এই পুরসভার প্রথম বাঙালি চেয়ারম্যান হন। প্রথম জীবনে অধ্যাপনা করতেন তিনি। পরে চিকিত্সাশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। দীর্ঘ কর্মময় জীবনে হালিশহরের উন্নতি নিয়ে শেষ দিন পর্যন্ত উদ্যমী ছিলেন এই মানুষটি। ‘হালিশহর’ নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাসবিহারী শাস্ত্রীর নাম। এই শহরের আর এক রূপকার ছিলেন তিনি। আরও বহু মানুষের অবদানে গড়ে উঠেছে আধুনিক শহরটি।
পুরপ্রধান অংশুমান রায় বলেন, “হালিশহরের অভিভাবক এই মানুষদের নামে কিছু করার স্বপ্ন আছে আমাদের। এত সম্পদ একটা ছোট্ট এলাকায়, অথচ তা কখনও এই শহরের গণ্ডি ছাড়ায়নি। আমরা চেষ্টা করছি আধুনিক ও সুন্দর করার পাশাপাশি বাইরের মানুষজনের কাছেও হালিশহরকে তুলে ধরতে।” ইতিমধ্যেই তার প্রস্তুতি অনেকটা নেওয়া হয়ে গিয়েছে। গঙ্গার মধ্যে প্রায় ২৭ একর চরায় হালিশহর ও গঙ্গার ও পারে বাঁশবেড়িয়ার পুরসভার উদ্যোগে তৈরি হচ্ছে রাজ্যের অন্যতম ইকো ট্যুরিজম সেন্টার। যেখানে গঙ্গাকে কেন্দ্র করে বিনোদনের বিভিন্ন ব্যবস্থা ও থাকা খাওয়ার বিলাসবহুল বন্দোবস্ত থাকবে। ইতিমধ্যেই প্রচুর গাছপালা দিয়ে ‘বিপিনবিহারী গঙ্গোপাধ্যায় উদ্যান’ তৈরি হয়েছে। সেখানে রামপ্রসাদ মুক্ত মঞ্চে পরিবেশকেন্দ্রিক থিয়েটার করার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। নিয়মিত গান-বাজনার আসর বসছে। সাধক রামপ্রসাদের ভিটে, মন্দির, পঞ্চবটী সব কিছুকে নিয়ে তৈরি হচ্ছে পর্যটন কেন্দ্র, অতিথিশালা। শহর ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য পরিবেশ-বান্ধব গাড়ি থাকবে। হালিশহর শ্মশানটিও নতুন করে সাজানো হয়েছে। তুলসি গাছের সারি দিয়ে শ্মশানের পরিচিত ছবির থেকে একেবারে আলাদা এই শ্মশানে ঠান্ডা ও গরম জলের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দু’টি ইলেকট্রিক চুল্লি এখন সব সময় কাজ করছে বলে জানালেন পুরপ্রধান। গঙ্গার ধারে ডানলপ ঘাটে প্রতিমা বিসর্জনের পর কাঠামো তুলে ফেলার জন্য ক্রেনের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
পানীয় জল, নিকাশি ও জঞ্জাল এক সময়ে শহরের বড় সমস্যা ছিল। এখনও গরমকালে ২, ৩, ৫, ৬ নম্বর ওয়ার্ডে পানীয় জলের সমস্যা থাকে। কখনও কখনও জল ঠিকমতো পরিস্রুত হয় না। কখনও সরু হয়ে জল আসে। পুরপ্রধান বলেন, “সামনের গরম কাল আসার আগেই অতিরিক্ত কয়েকটি বুস্টার পাম্প বসিয়ে জল সমস্যার সমাধান করে ফেলা হবে। নিকাশির সমস্যা নিয়ে পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। মাটির তলা দিয়ে নিকাশি ব্যবস্থা চালু করার জন্য আর্থিক অনুমোদন পাওয়া গিয়েছে। হালিশরে যে অংশগুলিতে বর্ষায় জল জমে, সেখানেও জল যাতে না জমতে পারে বা জমলেও চট করে বের করে দেওয়া যায়, তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।” ক্রমবর্ধমান জনবসতিতে জঞ্জাল সমস্যা মেটাতে ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ডাম্পিং গ্রাউন্ডটি যে যথেষ্ট নয়, তা মানেন পুরপ্রধান। তিনি বলেন, “আমরা সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টের বিষয়টি নিয়ে প্রাথমিক ভাবে আলোচনা করেছি। একেবারে জঞ্জালমুক্ত শহর করব হালিশহরকে।”
বীজপুরের প্রথম বিধায়ক হয়েছিলেন হালিশহরের বাসিন্দা বিপ্লবী বিপিনবিহারী গঙ্গোপাধ্যায়। উন্নয়নের কাজ শুরু হয়েছিল তাঁর হাত ধরেই। বীজপুরের বর্তমান বিধায়ক শুভ্রাংশ রায় বলেন, “হালিশহরের মতো প্রাচীন জনপদকে নির্মল ও সুসজ্জিত শহর করার প্রয়াস আছে আমাদের। এখানে কিছুটা রেলের জায়গা আছে। সেখানেও আমরা উন্নয়নের কাজে কোনও কার্পণ্য করিনি।” হালিশহর স্টেশন-সংলগ্ন রাস্তাটি দীর্ঘ দিন খারাপ থাকার পরে সম্প্রতি মসৃণ হয়েছে।
তবে রেলের কোচ ফ্যাক্টরি করার যে স্বপ্ন তত্কালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়িত হয়নি। মাঝখান থেকে রেলের আবাসনগুলি ফাঁকা করে দেওয়ায় অসামাজিক কাজকর্মের আখড়া তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ। ছাত্রী অঙ্কিতা দাস বলেন, “ফাঁকা রেল আবাসনে অসামাজিক কাজকর্ম ছাড়া হালিশহর এখন শান্ত। আগের থেকে অনেক সুন্দর। মেয়েদের নিরাপত্তাও অনেকটা নিশ্চিত হয়েছে।”
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy