ক্ষমতা হারানোর পরে লোকবল অনেকটাই কমেছে। নির্বাচনের কাজকর্ম সামলানোর জন্য ভরসা নতুন উঠতি মুখ। কমবয়সী ভোটারদের আকৃষ্ট করার তাগিদেও তরুণ মুখ দরকার। তাদের শিখিয়ে-পড়িয়ে তৈরি করতে হাতে-গরম নির্দেশিকা তৈরি করেছে সিপিএম।
‘কী করে ভাল কমিউনিস্ট হতে হয়’-এর এই নতুন পাঠে বলে দেওয়া হচ্ছে সাধারণ ভাবে সর্বজনগ্রাহ্য, হাল্কা রঙের পোশাক পরা বাঞ্ছনীয়... নকশা করা ঝলমলে, আঁটোসাঁটো পোশাক না পরাই শ্রেয়... বক্তব্য স্পষ্ট, ঋজু হওয়া প্রয়োজন... অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বাড়তি সঞ্চালন না হওয়া উচিত...
ভোটের কাজে যুক্ত কর্মীদের প্রচারের ‘টিপ্স’ হিসেবে এই নির্দেশিকা জারি করেছে সিপিএমের যাদবপুর ১ নম্বর জোনাল কমিটি। কর্মীদের শেখানোর জন্য, বিশেষত কমবয়সি ছাত্রছাত্রীদের জন্য, কর্মশালা হচ্ছে। রাজ্য কমিটির সদস্য ও যাদবপুর কেন্দ্রের প্রার্থী সুজন চক্রবর্তীর কথায়, “দলে অনেক নতুন মুখ উঠে আসছে। যাঁদের ব্যবহার করার জন্য সঠিক ভাবে তৈরি করে নেওয়া খুব জরুরি।”
যাদবপুর যে ভাবে লিখিত গাইডলাইন তৈরি করেছে, অন্যত্র এতটা না হলেও রাজ্যের সর্বত্রই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন রাজ্য নেতৃত্ব। কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্য বলেন, “এ বার ভোটারদের মধ্যে প্রায় ৫২%-এর বয়স ১৮ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। তাঁদের চাহিদার কথা মাথায় রাখতে হবে। এই জন্যই আমরা যেমন এক দিকে বিষয়ভিত্তিক ছোট ছোট পুস্তিকা, ফোল্ডার তৈরি করছি, সোশ্যাল মিডিয়ায় জোর দিচ্ছি, তেমনই চলনে-বলনে কর্মীদের সতর্ক থাকতে বলা হচ্ছে।”
এই সতর্কতার দরকার হচ্ছে কেন? সিপিএমের রাজত্বে দলীয় কর্মীদের উদ্ধত আচরণ যে বহু ক্ষেত্রে মানুষের মন বিষিয়ে দিয়েছে, সেটা এখন দলের অভ্যন্তরে স্বীকার করছেন বাম নেতারা। ফলে কর্মীদের হাবভাব-কথাবার্তা নতুন করে মানুষের বিরক্তি যাতে উদ্রেক না করে, সেটা নিশ্চিত করতে চাইছে দল। কর্মীদের
বলে দেওয়া হচ্ছে, পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে বিশেষ কাজ নেই। বরং সাম্প্রতিক ঘটনার উপরে সহজ কথা স্পষ্ট করে বলতে হবে। হাততালি কুড়োনোর টানে যা খুশি তাই বললে হবে না। যাদবপুর জোনাল কমিটির সম্পাদক সুব্রত দাশগুপ্তের দাবি, “নিজেকে কমিউনিস্ট বলে দাবি করলেই হয় না! অনেক শৈলী রপ্ত করতে হয়।”
এত দিন এই শৈলী রপ্ত হত কী ভাবে? দলীয় নেতৃত্বের একাংশের ব্যাখ্যা, সত্তর-আশির দশকের পার্টিতে যে শৃঙ্খলা ছিল, সেটা এখন তুলনায় আলগা। আগে তাত্ত্বিক বিষয় ছাড়াও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে নিয়মিত পার্টি-ক্লাস হত। এখন সে সব অনেক কম। দলের ঐতিহ্য ও ইতিহাস সম্পর্কেও এখনকার কর্মীরা ততটা অবহিত নন। যাঁরা এখন দলে আসছেন তাঁদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ভোগবিলাসের ছাপ স্পষ্ট। সেই কারণে এখন আলাদা করে পোশাক-আশাক নিয়ে সতর্ক করে দিতে হচ্ছে।
সমস্যা আরও আছে। সিপিএমে ‘নতুন মুখ’ তুলে আনাটা এই মুহূর্তে বড় চ্যালেঞ্জ। তাই অনেক আসনে অপেক্ষাকৃত তরুণ ও আনকোরাদের প্রার্থী করা হয়েছে। ঠিক হয়েছে, প্রচারেও সামনের সারিতে থাকবে নতুন ও তরুণ মুখ। কিন্তু এঁদের অনেকেরই মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখার কায়দাকানুন রপ্ত নেই। জোনাল কমিটি নাট্যপ্রশিক্ষণের ঢঙে পরামর্শ দিচ্ছে: ‘সামনের দিকে মুখ তুলে শ্রোতাদের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ রক্ষার ভঙ্গিমায় বলতে হবে। শ্রোতারা যদি চার পাশে থাকেন, তা হলে বক্তব্যের মাঝে মাঝে ডান ও বাঁ-দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাঁদেরও অ্যাড্রেস করতে হবে।’
তা ছাড়া দলীয় নেতৃত্ব লক্ষ করছেন, অনভিজ্ঞতার কারণেই প্রচারে অনেক সময়ে ‘অপ্রয়োজনীয়’ কথা বলে ফেলছেন নতুনরা। সস্তায় হাততালি পেতে গিয়ে অশালীন কথা বলে অতীতে অনিল বসু থেকে শুরু করে হাল আমলে আনিসুর রহমানের মতো পোড় খাওয়া নেতারাও বিড়ম্বনায় ফেলেছেন সিপিএমকে। সেই কুপ্রবণতা যাতে নতুনদের মধ্যে না ছড়ায়, তা খেয়াল রাখতে হচ্ছে। সুব্রতবাবুর যুক্তি, এ বারের ভোটে এক ঝাঁক নতুন ছেলেমেয়েকে মূল বক্তা হিসেবে প্রচারে নামাচ্ছেন তাঁরা। ৬০%-এরই বয়স তিরিশের মধ্যে। “সাধারণ ভাবে নতুন বক্তারা দলেরই কোনও নেতাকে নকল করে প্রচার করে। তাতে নিজস্বতাও থাকে না, ভাল বক্তাও তৈরি হয় না।”
অতএব প্রচারের ক্লাস, প্রচারশৈলীর ছাত্রবন্ধু। আমাদের কী করিতে হইবে...।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy