রাজ্যের বিভিন্ন জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের কাজে যাবতীয় সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যা শুনে কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণমন্ত্রী নিতিন গডকড়ীও আশাবাদী। তিনি বলেছেন, “মমতাজি জমি পেতে পূর্ণ সহযোগিতার কথা জানিয়েছেন।” জাতীয় সড়কের জন্য জমি-জট কাটাতে ফি মাসে রাজ্যের মুখ্য সচিব সঞ্জয় মিত্র বৈঠক করবেন বলেও স্থির হয়েছে। পরে বণিকসভার এক অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে জাতীয় সড়কের আটটি প্রকল্পের কাজ চলছে। মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি, দু’-তিন মাসের মধ্যে জমি অধিগ্রহণের সমস্যা মিটে যাবে।”
কিন্তু মঙ্গলবার নবান্নে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর এই আশ্বাসের পরে প্রশ্ন উঠেছে, বাস্তবের প্রেক্ষাপটে তাঁর এই মৌখিক সদিচ্ছার ওজন কতটা?
রাজ্য প্রশাসনের একটি অংশের বক্তব্য, জাতীয় সড়ক চার-ছ’লেন করার জন্য কেন্দ্র বহু কোটি টাকা বরাদ্দ করলেও তিন বছরে এক ছটাক জমিও অধিগ্রহণ করতে পারেনি তৃণমূল সরকার। জমি নিতে গিয়ে প্রশাসনকে যেমন নানা বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে, তেমনই কোনও কোনও ক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহণে সরকারের সদিচ্ছার অভাব প্রকট। “ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পে যে সরকার বাইপাসের ধারে দত্তাবাদে ৫০টি বাড়ি পর্যন্ত সরাতে পারে না, তারা প্রায় হাজার কিলোমিটার জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের জন্য জমি অধিগ্রহণ করবে, এটা বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি নয়” মন্তব্য এক আমলার।
ঘটনা হল, জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণ করতে গেলে ভূমিসংস্কার আইনে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে না। ফলে সরকার গঠনের গোড়া থেকে বিভিন্ন কাজে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে যে ছুৎমার্গ নবান্নের কর্তারা দেখিয়ে আসছেন, এ ক্ষেত্রে তার দরকারই পড়ছে না। রাজ্য পূর্ত ও সড়ক দফতরের এক কর্তা জানান, দেশের যে কোনও জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয় জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ আইনে (এনএইচএআই অ্যাক্ট)। এতে ক্ষতিপূরণের অঙ্ক বেশি, জমি নেওয়ার প্রক্রিয়াও দ্রুত শেষ করা যায়। পশ্চিমবঙ্গেও সেই আইন মেনে জমি অধিগ্রহণ করার কথা। তবে আইনটি কেন্দ্রীয় সংস্থার হলেও জমি অধিগ্রহণ করতে হবে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারকেই। ওই কর্তার কথায়, “এনএইচএআই আইনে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে বলে রাজ্য সরকারের নীতিগত আপত্তি নেই। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়।” কী রকম?
এনএইচএআই-সূত্রের খবর, ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের বারাসত থেকে কৃষ্ণনগর পর্যন্ত অংশে ১২০ হেক্টর, বহরমপুর-ফরাক্কায় ১০০ হেক্টর, রায়গঞ্জ-ডালখোলায় ১৪৭ হেক্টর এবং ডালখোলা বাইপাসের জন্য ১০ হেক্টর জমি দরকার। সড়কটি সম্প্রসারণের কাজ শুরু হয়েছে ২০১০-এ। গত চার বছরেও রাজ্য জমি-জটের সমাধান করে উঠতে পারেনি। একই ভাবে ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক (বম্বে রোড)-এর ডানকুনি-খড়গপুর, ২ নম্বরের (দিল্লি রোড) বারওয়া আড্ডা-পানাগড় অংশের বিভিন্ন স্থানে সামান্য জমি অধিগ্রহণ করতে না-পারায় সম্প্রসারণ থমকে রয়েছে। শিলিগুড়িতে ৩১ ডি জাতীয় সড়কের ঘোষপুকুর-ধুপগুড়ি অংশে ৩১০ হেক্টর এবং ধুপগুড়ি-সলসলাবাড়ির ৩০৪ হেক্টর অধিগ্রহণ না-হওয়ায় প্রকল্প এগোয়নি। অথচ টাকা এসে পড়ে রয়েছে।
এমতাবস্থায় এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসবাণী শুনে এনএইচএআইয়ের এক মুখপাত্র বলেন, “রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য জমি না-পাওয়াটাই যেখানে এ রাজ্যের দস্তুর, সেখানে এই প্রথম মুখ্যমন্ত্রী জানালেন, সমস্যা মিটিয়ে দেবেন। তাঁর কথায় ভরসা রাখতেই হবে। কিন্তু সত্যিটা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।” জমি নেওয়ায় সমস্যা ঠিক কোথায়?
রাজ্যের পূর্ত-কর্তাদের একাংশের বক্তব্য: ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক চার লেন করতে নেমে সব জায়গায় প্রয়োজনীয় জমি মিলছে না। সরকারের বহু খাস জমিতেও বেআইনি দখলদার ও বস্তি। উপরন্তু টেলিফোন-জল-বিদ্যুতের লাইন ও দু’পাশের অজস্র গাছও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাস্তার উপরে ধর্মস্থান গজিয়ে ওঠায় জমি আটকে পড়েছে। রয়েছে মালিকানার জটিলতাও। অনেক সময়ে অধিগ্রহণ করতে গিয়ে জেলা প্রশাসনের কর্তারা দেখছেন, যাঁর নামে জমি, তিনি অন্য কাউকে বেচে দিয়েছেন, যাঁর নাম রেকর্ডে নেই। কিছু ক্ষেত্রে মামলার ফাঁসে জমির ভবিষ্যৎ চলে গিয়েছে বিশ বাঁও জলে।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনের এক কর্তা জানাচ্ছেন, প্রায় সব জেলাতেই রাস্তার পাশে পূর্ত দফতরের খালি জমি রয়েছে। তার সিংহভাগ অবৈধ দখলদারের কব্জায়। কোথাও কয়েক পুরুষ ধরে শয়ে-শয়ে পরিবারের বসবাস। তা খালি করতে প্রশাসনকে হিমসিম খেতে হচ্ছে। রাজনৈতিক মদতে বলীয়ান ওই সব দখলদার পরিবার বা দোকানদারকে উচ্ছেদ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কোথাও আবার জমির দাম নিয়ে ঝঞ্ঝাট বাঁধছে। অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত এক কর্তার অভিযোগ, সমস্যা হলে রাজনীতির কথা মাথায় রেখে স্থানীয় নেতারা সামনে আসতে চান না, বরং প্রশাসনের ঘাড়ে বন্দুক রেখে কাজ সারতে চান। “বছর ঘুরে গেল, গাজল থেকে চাঁচল হয়ে কাটিহার যাওয়ার রাস্তায় বিদ্যুৎ-টেলিফোনের লাইন, জলের পাইপ সরাতে এনএইচএআই এক কোটি টাকা মঞ্জুর করেছে। টাকা পড়ে রয়েছে। কাজ কিছুই হয়নি।” আক্ষেপ করছেন তিনি।
এখন মুখ্যমন্ত্রী বলার পরেও কি সমস্যা মিটবে না? পূর্ত দফতরের এক শীর্ষ কর্তার প্রতিক্রিয়া, “নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর পর্বের পরে যা অবস্থা, তাতে পানের দোকানের জমি নেওয়াও কঠিন।” কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে সামনে পেয়ে মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিলেও তাতে সব জট কেটে জাতীয় সড়কের জন্য কয়েক হাজার একর জমি হাতে এসে যাবে, এই ভাবনাকে দিবাস্বপ্ন হিসেবেই দেখছেন প্রশাসনের কর্তারা।
মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি স্বপ্ন থাকবে না বাস্তব হবে, সময়ই বলবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy