Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

শরীরটা ভেঙে আসত, তবু হাল ছাড়িনি

পুরনো বছরের সেই সেপ্টেম্বরের রাত আর নতুন জানুয়ারির এই সন্ধেটার মধ্যে কত তফাত! ১৬ সেপ্টেম্বর রাতে গান-স্লোগানের আন্দোলন থামাতে টেনেহিঁচড়ে আমাদের সরিয়ে দিচ্ছিল পুলিশ। সমানে চলছিল কিল-চড়-ঘুষি। যন্ত্রণার মধ্যে জন্ম নিচ্ছিল একটা সঙ্কল্প। একটা নতুন কলরব।আর সেই মুহূর্ত থেকেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস হয়ে শহর কলকাতা, শহর কলকাতা হয়ে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ছিল কলরব।সেই কলরবই উল্লাস হয়ে ফেটে পড়ল এই ১২ জানুয়ারির সন্ধ্যায়। সাফল্যের উচ্ছ্বাসে!

শিবম ঘোষ
(তৃতীয় বর্ষ, প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং, যাদবপুর) শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:১০
Share: Save:

পুরনো বছরের সেই সেপ্টেম্বরের রাত আর নতুন জানুয়ারির এই সন্ধেটার মধ্যে কত তফাত!

১৬ সেপ্টেম্বর রাতে গান-স্লোগানের আন্দোলন থামাতে টেনেহিঁচড়ে আমাদের সরিয়ে দিচ্ছিল পুলিশ। সমানে চলছিল কিল-চড়-ঘুষি। যন্ত্রণার মধ্যে জন্ম নিচ্ছিল একটা সঙ্কল্প। একটা নতুন কলরব।

আর সেই মুহূর্ত থেকেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস হয়ে শহর কলকাতা, শহর কলকাতা হয়ে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ছিল কলরব।

সেই কলরবই উল্লাস হয়ে ফেটে পড়ল এই ১২ জানুয়ারির সন্ধ্যায়। সাফল্যের উচ্ছ্বাসে!

ভিসি সরছেন!

আমার বাড়ি খড়্গপুরে। এখানে হস্টেলেই থাকি। ১৬ সেপ্টেম্বরের রাতে সহ-আন্দোলনকারী বন্ধুদের সঙ্গেই ছিলাম অরবিন্দ ভবনের সামনেটায়। ভিসি-র ডাকে হাজির হয়েছিল পুলিশ। গভীর রাতে যখন আমাদের মেরেধরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তখন কলার ধরে তারাই আমায় ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। সিঁড়িতে মাথা ঠুকে গিয়ে চোট পাই। তার মধ্যেই অবশ্য ক্রমাগত মাড়িয়ে দিতে থাকে পুলিশের বুট। গভীর যন্ত্রণার মধ্যেই অবরোধে বসলাম যাদবপুর থানার সামনে। ভোরবেলা অবরোধ চলার সময়েই অজ্ঞান হয়ে গেলাম। জ্ঞান ফিরল হাসপাতালের আইসিইউ-এ। এক দিন পরে জেনারেল বেড।

আন্দোলনের সেই রাত, যন্ত্রণা আর সঙ্কল্পের সেই রাতটার পরে কলরব পৌঁছে গেল রাজপথে। মিটিং-মিছিল-স্লোগান তো বটেই, ফেসবুক-ট্যুইটার-হোয়াটসঅ্যাপে আমাদের আন্দোলন ছড়িয়ে গেল সর্বত্র। দেশের কোণে কোণে। বিদেশেও। যাদবপুরের পাশে তখন হাজার হাজার মুখ।

তবে পড়াশোনা, পরীক্ষা বা কেরিয়ারের ক্ষতি তো আর আমরা চাইনি। তাই নভেম্বরে খানিকটা থিতিয়ে গিয়েছিল আন্দোলন। আবার সেটা দানা বাঁধল এ বারের সমাবর্তনকে কেন্দ্র করে। সে-দিনের প্রতিবাদের ছবিটা এখন সকলের জানা। সে-দিনই আমরা বলেছিলাম, ভিসি পদত্যাগ না-করলে আন্দোলন আরও বড় আকার নেবে। তার পরে গত সোমবারের (৫ জানুয়ারি) জিবি (সাধারণ সভা)। এবং আমরণ অনশনের সিদ্ধান্ত। সেই রাত থেকেই অনশনে বসলাম। শরীরের কথা ভেবেছি। মা-বাবার কথাও। কিন্তু আন্দোলন থেকে পিছিয়ে আসার কথা ভাবতে পারিনি। আসলে জানতাম, আমাদের ১২ জনের পিছনে অন্তত ১২ হাজারের সমর্থন রয়েছে।

আমার বাবা শীতল ঘোষ রেলে চাকরি করেন। আন্দোলনের শুরু থেকেই বাবা আমাদের পাশে আছেন, অনশনের সিদ্ধান্তেও। মা (কল্যাণী ঘোষ) অবশ্য অনশনের কথা শুনে খানিকটা ভেঙে পড়েছিলেন। আসলে মায়ের মন তো! না-খেলে ছেলের অসুস্থ হয়ে পড়ার চিন্তাটা এড়াতে পারছিলেন না। মাকে বোঝালাম, এই আন্দোলন থেকে পিছিয়ে আসা যায় না। পারবও না।

তার পরে ১৬৪ ঘণ্টার লড়াই। ডাক্তাররা এসে দেখে যেতেন। শরীরটা ভেঙে আসত। তবু হাল ছাড়িনি। তার মধ্যেই শুক্রবার বিকাশ ভবনে গেলাম। শিক্ষামন্ত্রীর কথায় সে-দিন খানিকটা মধ্যপন্থার ইঙ্গিত ‘দেখছি, কী করা যায়।’ ওই রাতেই ব্লাড সুগার নেমে গিয়েছিল। তার পরেই ব্ল্যাক আউট। চোখ মেললাম ফের হাসপাতালের বেডে। সেখানে খানিকটা খাওয়াদাওয়া করতে হল অবশ্য। আর আন্দোলনকারী বন্ধুরাও খাওয়ার জন্য জোর করছিল। দেড় দিন পরে, রবিবার বিকেলে ফিরে এলাম অনশন মঞ্চে।

এবং অবশেষে সোমবারের সন্ধ্যা। ফলের রস খেয়ে অনশন ভাঙছি। বন্ধুরা অভিনন্দন জানাচ্ছে। ক্যাম্পাস জুড়ে শুধু খুশির হাওয়া।

জিতে গেলাম আমরা।

জিতে গেল কলরব।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE