প্রায় তিন দশকের ব্যবধান দু’টি ঘটনার মধ্যে। আপাত ভাবে কোনও যোগাযোগও নেই। যোগসূত্র শুধু এক ব্যক্তি। যাঁর পরিণতি দেখে সন্তানহারা সত্তর ছুঁই ছুঁই এক মায়ের উপলব্ধি, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।
সেই যোগসূত্রের নাম রজত মজুমদার। সারদা-কাণ্ডে গ্রেফতার হওয়া তৃণমূলের নেতা ও রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডি জি। তাঁর গ্রেফতারের দিনটিকে নিজের স্মরণে রাখার মতো তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ তারিখ হিসেবে যিনি মনে করছেন, সেই বৃদ্ধার নাম শক্তি রায়চৌধুরী। বেহালার বেচারাম চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাসিন্দা।
সারদার বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থায় টাকা রেখে তিনি যে প্রতারিত হয়েছেন, এমন নয়। তাই সারদা-কাণ্ডে সিবিআই-এর তদন্ত নিয়ে বাড়তি আগ্রহও নেই তাঁর। তা সত্ত্বেও বুধবার সংবাদপত্রে রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি-র গ্রেফতার হওয়ার খবর পড়ে ওই অনুভূতিই হল শক্তিদেবীর। বললেন, “এত দিন কেবল প্রার্থনা করেছি, যাদের জন্য আমার মেয়ে হারিয়ে গেল, যাদের জন্য আমার স্বামীকে হারালাম, তাদের যেন সাজা হয়। এ বার বুঝি ভগবান মুখ তুলে চাইলেন!”
কিন্তু রজত মজুমদারের গ্রেফতারকে নিজের ন্যায়বিচার পাওয়া বলে কেন মনে করছেন শক্তিদেবী?
’৮৬-র ৩০ সেপ্টেম্বর শক্তিদেবীর মেয়ে দেবশ্রী নিখোঁজ হয়। স্থানীয় থানায় ডায়েরি করেন বছর সতেরোর ওই কিশোরীর বাবা শ্যামাপদ রায়চৌধুরী। তাতে কাজ না-হওয়ায় পুলিশের উপরমহলে যোগাযোগ করেন তিনি। শেষে তদন্তের দায়িত্ব যায় সিআইডি-র তৎকালীন স্পেশাল সুপার রজতবাবুর হাতে। শ্যামাপদবাবুর অভিযোগ ছিল, তাঁর মেয়ের ব্যাপারে নির্দিষ্ট সূত্র পেয়েও তাকে উদ্ধারে সিআইডি যথেষ্ট তৎপর হয়নি।
সিআইডি জানায়, দেবশ্রী পুরুলিয়ার মানবাজারের বাসিন্দা এক যুবকের সঙ্গে চলে গিয়েছে। পরে তাদের ওড়িশায় গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ পাহারাতেই ওড়িশা থেকে ট্রেনে কলকাতায় আনা হচ্ছিল তাদের। কিন্তু রহস্যজনক ভাবে পথে ওরা পুলিশ হেফাজত থেকেই বেপাত্তা হয়ে যায়। রজতবাবু দাবি করেন, ট্রেন থেকে মহানদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে ওই তরুণ-তরুণী। তাদের দেহ জলে ভেসে গিয়েছে। রজতবাবুর ওই তত্ত্ব মেনে নিতে পারেনি রায়চৌধুরী পরিবার। রজতবাবুর অবস্থান অবশ্য তাতে বদলায়নি। এই ব্যাপারে পরেও বিভিন্ন সময়ে তিনি জানিয়েছেন, নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়েই ভেসে গিয়েছে দেবশ্রী ও তার সঙ্গী যুবক।
সেই ঘটনার পরে নিজের চেষ্টায় বিভিন্ন জায়গায় মেয়ের খোঁজ চালাতে থাকেন শ্যামাপদবাবু। ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মেয়েকে খুঁজতে যান পুরুলিয়ায়। ফেরার পথে ১৯৮৭-র ১৫ সেপ্টেম্বর হাওড়ার এক হোটেলে অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় তাঁর। দেহের পাশে পাওয়া যায় ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ ও ওষুধ। পুলিশের দাবি ছিল, হতাশায় আত্মহত্যা করেছেন শ্যামাপদবাবু।
রাজ্যের তৎকালীন তথ্য-সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উদ্যোগে স্কুলে শিক্ষিকার চাকরি পান শক্তিদেবী। ২০০৫ সালে অবসর নিয়েছেন। কিন্তু মেয়ের উধাও হয়ে যাওয়া এবং স্বামীর অস্বাভাবিক মৃত্যু দু’টি ক্ষেত্রেই পুলিশের ব্যাখ্যা সে দিনের মতো আজও মানতে নারাজ শক্তিদেবী।
তাঁর মেয়ের নিখোঁজ হওয়ার তদন্তের দায়িত্ব যে হেতু রজতবাবুর উপরেই ছিল, তাই শক্তিদেবী কোনও ভাবেই তাঁকে ক্লিনচিট দিতে রাজি নন এখনও। বলেন, “আমার ছেলে থাকে বিদেশে। আর আমি এখানে ক্যালেন্ডারের পাতায় দু’টি তারিখ আঁকড়ে দিন কাটাই। ৩০ সেপ্টেম্বর যে দিন মেয়ে নিখোঁজ হল, আর ১৫ সেপ্টেম্বর যে দিন আমার স্বামীকে হারিয়েছি। এ বার মনে রেখে দেওয়ার মতো আরও একটা তারিখ পেলাম। ২০১৪-র ৯ সেপ্টেম্বর।”
সারদা-কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে প্রাক্তন পুলিশকর্তা রজত মজুমদারকে সিবিআই গ্রেফতার করেছে ওই তারিখেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy