লেখক সিলভিয়া প্লাথ। নিজস্ব চিত্র।
সম্প্রতি নিলাম হল ষাটের দশকের বিখ্যাত কবি, প্রাবন্ধিক ও ছোটগল্পকার সিলভিয়া প্লাথের কিছু স্মারকের। আয়োজন করেছিলেন তাঁর একমাত্র কন্যা ফ্রিডা হিউজ। তিনি নিজেও এক জন কবি ও চিত্রশিল্পী।
অল্পবয়স থেকেই মানসিক অবসাদ সিলভিয়া প্লাথের নিত্যসঙ্গী। অবসাদের হাত থেকে বাঁচতে গ্যাস বার্নারের আগুনে মাথা চেপে নিজেকে শেষ করে দিয়েছিলেন তিনি।
সিলভিয়া প্লাথের জীবনের বহু স্মৃতি, অনেক স্মারক তাঁর কন্যা ফ্রিডার কাছে এত দিন সযত্নে রক্ষিত ছিল। তিনি সেগুলো এত দিন পর প্রকাশ্যে আনলেন। নিলামের শিরোনাম, ‘ইয়োর ওন সিলভিয়া’।
ফ্রিডা নিজে কবি হয়েও প্রায় তিন দশক বাবা টেড হিউজকে কিছু বলেননি। কবিতা লিখে সেগুলো জুতোর বাক্সে লুকিয়ে রাখতেন। এক দিন বাবাকে বলেছিলেন, “মেয়ে হিসেবে নয়, কবি হিসেবে এই কবিতাগুলো দেখতে।” টেড তা-ই করেছিলেন। ফ্রিডার মা সিলভিয়া প্লাথও তা-ই করতেন। কোনও দিন কবিতা লিখে প্রেমিক, স্বামী টেডকে দেখাননি। লুকিয়ে রাখতেন। ফ্রিডা বলছেন, “আই হ্যাড আ ফিয়ার অব সিমিলারিটি, আই ওয়ান্টেড টু বি জাজড বাই মাই ওন মেরিট।” ফ্রিডাকে একটি কবিতাও পরিমার্জন করতে বলেননি টেড হিউজ। ফ্রিডার আরও একটি ভয় ছিল, তাঁর কবিতায় যেন তাঁর বাবা-মার প্রভাব না পড়ে।
ফ্রিডার অত বড় এক জন কবি বাবা, টেডের সঙ্গে যে রকম সম্পর্ক ছিল, মা সিলভিয়া প্লাথের সঙ্গে তাঁর নিজের বাবার সম্পর্ক সে রকম ছিল না। ছোট থেকেই বাবাকে তিনি ভয় পেতেন। ছোট মেয়ে সিলভিয়া কিছুতেই বাবার মনের তল পেত না।
নানা ভাবে বাবাকে ভোলানোর চেষ্টা করত সিলভিয়া। কিন্তু বাবা ছিলেন প্রচণ্ড একগুঁয়ে, জেদি। সিলভিয়া ‘ড্যাডি’ কবিতায় তাঁর বাবাকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। মা-কে দু’টি ছোট ছেলেমেয়ের দায়িত্ব দিয়ে বাবা চলে গেলেন ডায়াবিটিসে। শেষ সময়ে ডাক্তার এবং আধুনিক চিকিৎসাও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এই ঘটনা সিলভিয়ার ব্যক্তিজীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল। অনেকে মনে করেন, পরবর্তী কালে সিলভিয়ার আত্মহত্যার গূঢ় কারণ তাঁর বাবার স্বভাব ও অকালে চলে যাওয়া।
বাবা যখন চলে যান, তখন সিলভিয়ার মাত্র সাড়ে আট বছর বয়স। ভাইয়ের বয়স আরও কম। বাবার মৃত্যুর পর সিলভিয়া মা অরেলিয়াকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মা-র তখন অনেক দায়িত্ব— ছোট দুটো ছেলেমেয়েকে মানুষ করা, বাবার অবর্তমানে সন্তানদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করা। সংসারে সন্তানদের ভরণপোষণের জন্য যথেষ্ট টাকার দরকার। কাজেই সিলভিয়া যখন মা-কে চাইতেন, মা-র তখন সময় নেই। শুধু কর্তব্য, আর দুই ছেলেমেয়েকে ঘিরে অসীম স্বপ্ন। অনেকে বলেন, তখন থেকেই সিলভিয়ার মনে জটিলতা বাসা বাঁধে— মা-কে না পাওয়া এবং তাঁকে নিয়ে মায়ের চূড়ান্ত প্রত্যাশায়। রাতের পর রাত ঘুমোতে পারতেন না তিনি।
সিলভিয়া প্লাথের মতো বিশিষ্ট কবির স্মারক সাধারণ মানুষেরও দেখার কৌতূহল ছিল। সেই কথা মাথায় রেখেই তাঁর কন্যা ফ্রিডা ‘সদবি’-র মাধ্যমে তাঁর স্মারক এই ভাবে সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। মোট ৫৫টি স্মারক নিয়ে ফ্রিডা এই নিলাম করেন। সব মিলিয়ে প্রায় দশ লক্ষ পাউন্ডের মতো দাম ওঠে।
সিলভিয়া প্লাথ যখন মারা যান, তখন তাঁর বয়স মাত্র ত্রিশ বছর। এক কন্যা ও এক পুত্রকে রেখে সিলভিয়া আত্মহত্যা করেন। তখন ফ্রিডার বয়স তিন বছর, ভাই নিকোলাসের এক। দু’জনের জন্য সকালের ব্রেকফাস্ট পর্যন্ত করে রেখে যান তিনি। ফ্রিডা হিউজের নিলাম করা জিনিসগুলোর মধ্যে ছিল সিলভিয়ার একটি সামার ড্রেসও। সেই সময়ের পক্ষে সামার ড্রেসটি যথেষ্ট ফ্যাশনেবল। সেটির দাম উঠেছিল প্রায় ৯০০ পাউন্ড। এই নিলামে টেড হিউজকে লেখা সিলভিয়ার প্রায় ১৬টির মতো চিঠি ছিল। তাতে ছিল তাঁদের নববিবাহিত জীবনের ভালবাসার নানা কথাও। সেগুলিও নিলাম হয়।
নিলামে ছিল সিলভিয়া প্লাথের দু’টি আলোকচিত্রও, তুলেছিলেন এরিখ স্টালবার্গ। ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইংল্যান্ডের নর্দাম্পটনের একটি স্টুডিয়োতে ছবিদু’টি তোলা হয়। তখন সিলভিয়ার গলায় মুক্তোর একটি নেকলেস ছিল।
শৈশব থেকে মানসিক জটিলতা আর নানা অপ্রাপ্তিই সিলভিয়াকে আত্মহত্যাপ্রবণ করে তুলেছিল। এর আগেও এক বার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণায়। বস্টনে থাকাকালীন তিনি হার্ভার্ডের সামার স্কুলে একটি সাহিত্যসভায় কবিতাপাঠের জন্য আবেদন করেন। স্বরচিত কবিতা আবেদনপত্রের সঙ্গে পাঠিয়ে সিলভিয়া নিশ্চিত ছিলেন যে, তাঁর কবিতাগুচ্ছ নির্বাচিত হবে। কিন্তু হার্ভার্ড থেকে চিঠি এল অমনোনয়নের দুঃসংবাদ বয়ে। সিলভিয়া জীবনে কখনও এত বড় আঘাত পাননি। তাঁর জীবনীকার এডওয়ার্ড মুশার লিখছেন, “এই প্রত্যাখ্যান তাঁর সবচেয়ে দুর্বল জায়গায় আঘাত করল। আহত হল তাঁর আত্মসম্মান। নিজস্ব প্রতিভা আর মূল্য সম্বন্ধে যে সন্দেহ তাঁর মনে দানা বাঁধছিল, তা বাড়িয়ে তুলল। হার্ভার্ড থেকে প্রত্যাখ্যানপত্র পেয়ে সবার আগে তাঁর মনে হল, মায়ের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে সমর্থ হননি তিনি। ডায়েরিতে লিখলেন, ‘আমার প্রত্যাখ্যান ভীতি জড়িয়ে আছে আমার অন্য ভয়ের সঙ্গে, এই প্রত্যাখ্যান আসলে আমার মায়ের কাছে প্রত্যাখ্যান। জীবনে অসফল হওয়ার ভয়। তাই এই ভয় এত ভয়ঙ্কর।’” পিতৃহীন দুই সন্তানকে মানুষ করার জন্য তাঁর মায়ের চেষ্টার অন্ত ছিল না। তবু সে চাপ সিলভিয়ার কাছে মাঝেমধ্যেই ভয়াবহ হয়ে উঠত।
ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে সিলভিয়া যখন বস্টন থেকে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজে পড়তে এলেন, তখন তাঁর দিনাতিপাতের বিস্তারিত বর্ণনা চিঠিতে লিখতেন মাকে। তিনি তখন কেমব্রিজে ইংরেজি সাহিত্যের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। এক দিন কলেজ-পত্রিকায় পেলেন টেড হিউজের কবিতা। পড়ে এত ভাল লাগল সিলভিয়ার যে, ঠিক করলেন কবির সঙ্গে আলাপ করবেন। পরের দিনই লাঞ্চে ছুটলেন কবির সঙ্গে আলাপ করতে। বাকিটা ইতিহাস।
বিশ শতকের ইংল্যান্ড ও আমেরিকার সাহিত্যজগতে এই প্রেম সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ১৯৫৬ সালে তাঁরা বিয়ে করেন। ১৯৬০ সালে সিলভিয়া প্লাথ লেখেন ‘বেল জার’-এর মতো রক্তাক্ত উপন্যাস। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রকে দিয়ে তিনি বলিয়েছিলেন, “মেয়েদের যাপনে যদি বিদ্রোহ থাকে, তা হলে সেই দ্রোহ কোনও সৃষ্টিশীল নারীর মনেও অহরহ ছাপ ফেলে।” অনেক সমালোচক মনে করেন, সিলভিয়া প্লাথই প্রথম এই কথা মেয়েদের সম্বন্ধে অনুভব করেছিলেন।
টেড হিউজকে বিয়ে করার আগেই তিনি যথেষ্ট খ্যাতনামা। বিশেষ করে ‘ব্ল্যাক পোয়েম’-এর জন্য তিনি বিখ্যাত ছিলেন। তাঁর কবিতায় এত রূপক, এত ভাঁজ অন্য কারও কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায় না। জীবন-যাপনে তিনি অত্যন্ত সৎ ছিলেন। তাই বিয়ের কিছুকাল পরেই স্বামী টেড হিউজের জীবনে অন্য নারীর উপস্থিতি তিনি মেনে নিতে পারেননি কিছুতেই। নিজেকে শেষ করে দিয়েছেন অবিলম্বে। ‘সদবি’র এই নিলামে তাঁর বিয়ের আংটিও ছিল। এই নিলামে সিলভিয়ার প্রিয় আরও প্রায় ৫০টির মতো জিনিস ছিল। ছিল কবির প্রিয় ফ্রেঞ্চ ট্যারট কার্ড। শোনা যায় সিলভিয়ার চব্বিশতম জন্মদিনে তাঁর স্বামী টেড হিউজ সিলভিয়াকে এই ট্যারট কার্ড উপহার দিয়েছিলেন। মধুচন্দ্রিমায় প্যারিসে যাওয়ার সময় জাহাজের ডেকে বসে তিনি এই ট্যারট খেলতেন। তখন টেড হিউজের একটি প্রতিকৃতিও এঁকেছিলেন সিলভিয়া। এ ছাড়াও নিলামে ছিল পারিবারিক ছবির একটি অ্যালবাম, একটি বেলুন, রোলিং পিনের মতো কিছু রোজকার ব্যবহারের জিনিস।
যে মহিলার জন্য টেড হিউজ সিলভিয়াকে ছেড়েছিলেন, তাঁর নাম আসিয়া উইভিল। তাঁর একটি মেয়ে ছিল, শুরা। সিলভিয়ার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর টেড হিউজ লন্ডনে একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন, সেখানেই সিলভিয়ার আত্মহত্যার খবরটা পান। পরে আসিয়া অনেকটা সিলভিয়ার মতোই আত্মহত্যা করেন। নিজের মেয়েকেও হত্যা করেন মৃত্যুর আগে।
সিলভিয়া প্লাথের বিখ্যাত বই ‘এরিয়েল’ তাঁর মৃত্যুর দু’বছর পরে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়াও তাঁর অনেক বই প্রকাশিত হয় মৃত্যুর পর। সেই বইয়ের বেশির ভাগই সম্পাদনা করেন টেড হিউজ।
গ্রন্থঋণ: ‘দ্য জার্নালস অব সিলভিয়া প্লাথ’— টেড হিউজ, সিলভিয়া প্লাথ পোয়েমস,‘বিটার ফেম: আ লাইফ অব সিলভিয়া প্লাথ’— অ্যানি স্টিভেনসন, ‘বেল জার’— সিলভিয়া প্লাথ, ‘সিলভিয়া প্লাথ: কবিতার জীবন জীবনের কবিতা’—ঊর্মিলা চক্রবর্তী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy