ভোট মিটতেই ফের মাথা চাড়া দিল বাসভাড়া বৃদ্ধির দাবি। যা আদায় করতে পশ্চিমবঙ্গের বেসরকারি বাস-মালিক সংগঠনগুলি জোরকদমে আন্দোলনে নামার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে।
লোকসভা নির্বাচনের শেষ পর্বের ভোটগ্রহণ শেষ হতে না-হতেই, গত ১২ মে ডিজেলের দাম বেড়েছে লিটারে ১ টাকা ২৯ পয়সা। ১৪ তারিখে রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রীকে এ নিয়ে চিঠি দিয়েছেন বাস-মালিকেরা, যার উত্তর এখনও মেলেনি। এমতাবস্থায় মালিকদের হুঁশিয়ারি, ভাড়াবৃদ্ধির দাবিতে আগামী সপ্তাহে তাঁরা ‘তীব্র’ আন্দোলন শুরু করবেন। মালিক মহলের খবর, আগামী বুধ কিংবা বৃহস্পতিবার তাঁদের পাঁচটি সংগঠন বৈঠকে বসছে। সেখানে পরবর্তী আন্দোলনের রূপরেখা চূড়ান্ত করা হবে। রাজ্যের কী বক্তব্য?
পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র এ প্রসঙ্গে সরাসরি কোনও মন্তব্য করেননি। রবিবার তিনি জানিয়েছেন, ডিজেলের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির জেরে বাস-মালিকদের কতটা ক্ষতি হচ্ছে, সরকার প্রথমে তা যাচাই করতে চায়। সে জন্য আজ, সোমবার সরকারি পাঁচটি নিগমের কর্তাদের সঙ্গে তিনি বৈঠকে বসবেন। “জ্বালানির দাম বাড়ায় নিগমগুলোর কতটা লোকসান হচ্ছে, তা বুঝে সরকার পরবর্তী পদক্ষেপ করবে।” মন্তব্য মদনবাবুর।
পশ্চিমবঙ্গে বাসভাড়া শেষ বেড়েছে ২০১২-র অক্টোবর-নভেম্বরে। তখন ডিজেলের দাম ছিল লিটারপিছু ৫০ টাকা ৭৮ পয়সা। তার পরে এই দেড় বছরে নয় নয় করে ১৮ বার ডিজেলের দাম বেড়েছে, এখন কলকাতায় লিটার ৬১ টাকা ৩৮ পয়সা। অর্থাৎ প্রায় ২০% মূল্যবৃদ্ধি! জ্বালানির পাল্লা দিয়ে মহার্ঘ হয়েছে যন্ত্রাংশ। তার সত্ত্বেও সরকার ভাড়া বাড়াতে নারাজ। কারণ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, বাসভাড়া বাড়ালে সাধারণ মানুষের উপরে চাপ বাড়বে। মালিকদের পাল্টা যুক্তি, ভাড়া না-বাড়ায় বাস চালিয়ে বাড়তি খরচ পোষানো যাচ্ছে না। “লোকসান পুইয়ে ব্যবসা করব কেন?” প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা।
এবং প্রশ্নের যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর না-মেলায় বহু বেসরকারি মালিক যেমন বাস বসিয়ে রাখছেন, তেমন সরকারি পরিবহণ নিগমগুলোর হালও তথৈবচ। তাদের বোঝার ভার বাড়িয়েছে বাড়তি কর্মীর চাপ। অর্থাভাবে বিভিন্ন নিগমের বিস্তর বাস রাস্তায় নামানো যাচ্ছে না। যে ক’টা চলছে, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলোও লজ্ঝরে। সব মিলিয়ে আমজনতার ভোগান্তির একশেষ। রাস্তায় বেরিয়ে বাস না-পেয়ে বহু নিত্যযাত্রীকে রিকশা-অটো-ট্যাক্সি-মেট্রো ইত্যাদিতে যাত্রাপথ ভেঙে ভেঙে গন্তব্যে পৌঁছাতে হচ্ছে। পকেট থেকে খসছে বেশি। হিসেব কষে অনেকে দেখেছেন, মালিকদের দাবিমতো বাসে উঠে বাড়তি ভাড়া গুণতে হলেও খরচ তুলনায় কম হতো, ঝক্কিও এত পোহাতে হতো না। সম্প্রতি একটি জনস্বার্থ-মামলার সূত্রে কলকাতা হাইকোর্টও সমস্যাটির দিকে রাজ্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
সরকারের নির্লিপ্তি কাটাতে বাস-মালিকেরা এর মধ্যে একাধিক বার ধমর্ঘট-আন্দোলন করেছেন। ভাড়াবৃদ্ধির দাবিতে রাজ্যে শেষ বাস ধর্মঘট হয়েছিল গত জানুয়ারিতে। সরকার অবশ্য তাতেও অবস্থান বদলায়নি। মালিকদের একাংশের মতে, আসন্ন লোকসভা ভোটের কথা ভেবেই সরকার তখন বাসবাড়া বাড়ানোর মতো ‘অপ্রিয়’ সিদ্ধান্তের পথে হাঁটেনি। “ভোট মিটে গিয়েছে। এ বার সরকারের উচিত বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করা। নচেৎ এ রাজ্যে পরিবহণ শিল্প মুখ থুবড়ে পড়বে।” এ দিন বলেন ‘বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেট’-এর নেতা দীপক সরকার। বেসরকারি বাস-মালিকদের আর এক সংগঠন ‘জয়েন্ট কাউন্সিল অব বাস সিন্ডিকেটস’-এর তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “আমরা তিন বার বন্ধ করেছি। বহু বার মন্ত্রীকে দাবিপত্র দিয়েছি। কিছুই হয়নি। সরকার রাজনৈতিক স্বার্থের কথা ভাবছে। অন্য দিকে পরিবহণ শিল্প উঠে যাওয়ার জোগাড়!” বেসরকারি বাসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মিনিবাসও ভাড়াবৃদ্ধির আন্দোলনে সামিল হতে তৈরি। ‘মিনিবাস অপারেটর্স কো-অর্ডিনেশন কমিটি’র অবশেষ দাঁ বলেন, “যা করার, আমরা একসঙ্গে বসে ঠিক করব।”
পরিবহণ দফতরের কর্তাদের অনেকে অবশ্য মনে করছেন, এ বার বাসভাড়া বাড়লেও বাড়াতে পারে। এক কর্তার মন্তব্য, “জ্বালানির দাম যে জায়গায় পৌঁছেছে, তাতে ভাড়া না-বাড়লে বাস চালানো যাবে না। সামনে ভোটও নেই। আশা করা যায়, সরকার এখন ব্যাপারটাকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখবে।”
বস্তুত সেই আশাতেই বুক বেঁধেছেন বাস-মালিকেরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy