Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

নজর কাড়তে বাসে, বাজারে, নদীতেও প্রার্থী

রোড শো-এ বেরিয়েছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ২০১১ বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারপর্ব তখন তুঙ্গে। যাদবপুর কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী বুদ্ধবাবুর সঙ্গে সে দিন রোড শো-এ সামিল আশপাশের চার বিধানসভা কেন্দ্রের চার বামফ্রন্ট প্রার্থীও। হাজার-হাজার বাম সমর্থকের ভিড়ে রাস্তা ছয়লাপ। তামাম তল্লাট ঢাকা পড়েছে লাল পতাকায়।

অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

অত্রি মিত্র
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:০৬
Share: Save:

রোড শো-এ বেরিয়েছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।

২০১১ বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারপর্ব তখন তুঙ্গে। যাদবপুর কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী বুদ্ধবাবুর সঙ্গে সে দিন রোড শো-এ সামিল আশপাশের চার বিধানসভা কেন্দ্রের চার বামফ্রন্ট প্রার্থীও। হাজার-হাজার বাম সমর্থকের ভিড়ে রাস্তা ছয়লাপ। তামাম তল্লাট ঢাকা পড়েছে লাল পতাকায়। বুদ্ধবাবু হুডখোলা জিপে সওয়ার। রাস্তার ধারে জড়ো হওয়া মানুষদের কখনও নমস্কার করছেন, কখনও হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন উদগ্রীব সমর্থকদের দিকে।

তদানীম্তন মুখ্যমন্ত্রীর ওই সড়ক-প্রচারের ক’দিন আগে একই রাস্তায় রোড শো করে গিয়েছিলেন তদানীন্তন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যাদবপুর কেন্দ্রে তৃণমূলের ‘আমলা’ প্রার্থী মণীশ গুপ্তের সমর্থনে। মমতার মিছিলের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনা না-করেও নিজেদের মিছিলে জমায়েতের বহর দেখে আশায় বুক বেঁধেছিলেন সিপিএম নেতারা। কিন্তু ১৩ মে ভোটের ফল বেরোলে দেখা গেল, বুদ্ধদেববাবু কয়েক হাজার ভোটে পরাজিত! সেনাপতির সঙ্গে ধরাশায়ী লাগোয়া চার কেন্দ্রের অন্য চার

বাম প্রার্থীও!

তিক্ত সেই অভিজ্ঞতার পরে ভোট প্রচারে এমন জৌলুসের রোড শো-এর কার্যকারিতা সম্পর্কে সিপিএম নেতৃত্ব খানিকটা সন্দিহান। এক নেতার কথায়, “এ ধরনের মিছিলে দলের সদস্য-সমর্থকেরাই ভিড় জমান। আমজনতার মন সে ভাবে বোঝা যায় না।”

লোকসভা নির্বাচনে তাই ওঁরা কৌশল পাল্টাচ্ছেন। পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরে চিরাচরিত কায়দায় প্রচার অবশ্য চলবে। তবে হুডখোলা জিপে নয়। হুডখোলা অটো তা-ও চলতে পারে। “সবচেয়ে ভাল হল পায়ে হেঁটে ঘোরা। মানে, মানুষের একেবারে গা ঘেঁষে থাকা।” বলছেন ওই নেতা। হাট-বাজারের সুযোগ নেওয়াও ওঁদের লক্ষ্য। ছুটির দিনে শহুরে বাজারে কিংবা গ্রামের হাট-বারে একসঙ্গে এক জায়গায় বহু মানুষকে পাওয়া যায়। ওই বাজারি ভিড়কে ‘টার্গেট’ করেছেন সিপিএম প্রার্থীরা। যেমন সুজন চক্রবর্তী। কোনও রবিবারে গড়িয়ায়, কোনও রবিবারে বাঘা

যতীন বা রাজপুর বাজারে চলছে তাঁর প্রচার-অভিযান।

শুধু সিপিএম নয়। তৃণমূল, বিজেপি, কংগ্রেস প্রচারের মাঠে নতুনত্বের হাওয়ায় গা ভাসিয়েছেন হরেক দলের হরেক প্রার্থী। কী রকম?

ধরা যাক হাওড়ার তৃণমূল প্রার্থী প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা, যিনি কিনা একসঙ্গে বহু ভোটারকে নাগালে পেতে ভিড়ে ঠাসা বাসকে বেছে নিয়েছেন। সটান বাসে উঠে গিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে খোশগল্প জুড়ে সুকৌশলে প্রচারের কাজটি সেরে ফেলছেন প্রাক্তন ফুটবলার। একই ঢঙে ট্রেনে চড়ছেন আরামবাগের কংগ্রেস প্রার্থী শম্ভুনাথ মল্লিক। বনগাঁর বিজেপি প্রার্থী কেডি বিশ্বাসও অভিনবত্বের দৌড়ে পিছিয়ে নেই। কখনও তিনি বনগাঁ লাইনের ট্রেনে উঠে পড়ছেন, কখনও আবার কচুরিপানা সাফ করতে নিজেই নেমে পড়ছেন ইছামতীতে। পাশাপাশি হাল আমলের ‘হাইটেক’ প্রচার তো আছেই। এসএমএস, ফেসবুক মারফত ভোটার হৃদয়ে পৌঁছানোর লাগাতার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন বিস্তর প্রার্থী। সিপিএম তো ফেসবুক-এসএমএস করার জন্য আসনপিছু চার-পাঁচ জনের কমিটি-ই বানিয়ে ফেলেছে! তারকাদের প্রচারে আবার গ্ল্যামারের ছড়াছড়ি। মুনমুন সেন বা দেব বেরোলে মানুষে-মানুষে পথ ছয়লাপ। বাবুল সুপ্রিয়-বাপ্পি লাহিড়ি গান গেয়ে ভিড় বাড়াচ্ছেন। অর্পিতা ঘোষের মতো নাট্যকর্মীর প্রচারে সামিল হচ্ছেন তাঁর পেশাগত সতীর্থরা। জাদুকর পিসি সরকার (জুনিয়র)-ও কসুর করছেন না। ‘কিছু বলবেন না’ বলে মুখে লিউকোপ্লাস্ট এঁটে চেষ্টা করছেন অনেক কিছু বলে দেওয়ার।

বিবিধ কেতা, বিভিন্ন কায়দা। উদ্দেশ্য একটাই ভোটারকুলের নজর আকর্ষণ। যে প্রসঙ্গে পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ তথা ঘাটালের কংগ্রেস প্রার্থী মানস ভুঁইয়ার মন্তব্য, “প্রার্থী হচ্ছেন কন্যার পিতার মতো। দলের যাতে উপকার হবে, সেটাই করবেন। বাঁধাধরা নিয়ম নেই।” তবে মানসবাবু এ-ও জানাতে ভুলছেন না যে, “শেষমেশ ভোটটা দেন জনসাধারণ। সেখানে কারও জোর চলে না।” তাঁর প্রচার চলে কী ভাবে?

মানসবাবুরও প্রচারের নিজস্ব ধরন আছে। প্রথমে এলাকার নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সভা করে কৌশল ছকে ফেলা। কেন্দ্রের বিভিন্ন এলাকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি যাচাই করা। এর পরে সদলে ময়দানে নেমে পড়া। “হাঁটা, গাড়ি, পথসভা এ সব তো আছেই।

ভোটের হিসেব উল্টে দিতে পারেন, এমন গুরুত্বপূর্ণ লোকজনের সঙ্গে আলাদা ভাবে গিয়ে কথা বলতে হয়।” জানাচ্ছেন প্রবীণ কংগ্রেস নেতা। অন্য দিকে দক্ষিণ কলকাতার তৃণমূল প্রার্থী সুব্রত বক্সি কিংবা দলের নেতা তথা মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় পূর্ণ আস্থা রাখছেন প্রচারের সনাতনী ঘরানায়। “একাত্তর থেকে ভোটে লড়ছি। যা বুঝেছি, ভোটারদের কাছে পৌঁছানোটাই আসল। কারণ, ভোটারদের একটা ইগো এখানে কাজ করে।” পর্যবেক্ষণ মন্ত্রী সুব্রতবাবুর। যিনি মনে করেন, বাজারে হাজির হয়ে কিংবা বাসে-ট্রেনে চড়ে গিমিক দেওয়া গেলেও ভোটের বাক্সে ফায়দা তোলা মুশকিল। প্রার্থী সুব্রতবাবুও জানাচ্ছেন, তিনি বরাবর অলি-গলিতে হেঁটে, দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে ভোটারদের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করে থাকেন। চমক-চটকে তাঁরও বিশ্বাস নেই।

ওঁদের মতো রক্ষণশীল নন রাজনৈতিক নেতাদের যে অংশ, তাঁরা পাল্টা যুক্তি দিচ্ছেন। এই মহলের প্রশ্ন, “এখন বিজ্ঞাপনের যুগ। সর্বত্র অভিনবত্বের কদর। ফুটবল-ক্রিকেটের মাঠে বহুজাতিকেরা পণ্যের গুণাগুণ প্রচারের সুযোগ ছাড়ে না। ভোটের মাঠে নিজেদের জাহির করার মওকা প্রার্থীরাই বা কেন হাতছাড়া করবেন?” এক ধাপ এগিয়ে বসিরহাটের বিজেপি প্রার্থী শমীক ভট্টাচার্যের দাবি, নির্বাচনী প্রচারে অভিনবত্ব আনার প্রবণতা বিদেশেও আছে। “আমি ব্রিটেনে দেখেছি, ডেভিড ক্যামেরন লন্ডনের মাছের বাজারে গিয়ে ভোট চাইছেন! অনেক প্রার্থী বাসে-ট্রেনে উঠছেন।” বলেন শমীকবাবু। তাঁর নিজেরও বাজার-ট্রেন-বাসে যথেষ্ট ভরসা। তবে ‘হাইটেক’-এ বিশেষ নয়। কেন?

শমীকবাবুর যুক্তি, “বিহারে গত বিধানসভা নির্বাচনে তো রাহুল-ব্রিগেড ব্যাপক হাইটেক প্রচার চালিয়েছিল। তার পরেও বিজেপি-জেডিইউ জোট বিপুল ভোটে জিতেছে!”

পুরো ব্যাপারটাকে বিশেষজ্ঞেরা কী ভাবে দেখছেন? বিপণন-বিশেষজ্ঞ রাম রে বলেন, “যুগ পাল্টেছে, প্রযুক্তি পাল্টেছে। সঙ্গে বিপণনের কায়দা বদলেছে। তাল মিলিয়ে রাজনীতিবিদেরা নিজেদের পাল্টাচ্ছেন। তাঁদের বক্তব্য পাল্টাচ্ছে। ভোটারেরা যা শুনতে চাইছেন, নেতারা তা-ই বলছেন।”

অন্য বিষয়গুলি:

election campaign bus train atri mitra
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE